হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল সংঘাত, মধ্যপ্রাচ্য কি তবে ভিয়েতনাম হতে যাচ্ছে!
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ১০:০৮ পিএম, রবিবার, ৪ আগস্ট ২০২৪ আপডেট: ১০:০৮ পিএম, রবিবার, ৪ আগস্ট ২০২৪
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধ আরও তীব্র ও বিস্তৃত রূপ নিয়েছে। এটা শুধু দুই দেশ নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে। সম্প্রতি ইরানের প্রক্সি হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা বাড়িয়েছে।
গত শনিবার রাতে ইসরায়েল লেবানন ভূখণ্ডে সিরিজ বিমান হামলা চালিয়েছে। তেল আবিব বলেছে, ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে একটি ফুটবল মাঠে হিজবুল্লাহর হামলায় হতাহতের ঘটনায় তারা বিমান হামলা চালায়। তেহরানের দিক থেকে সতর্ক করা হয়েছে যে লেবাননে ইসরায়েল আগ্রাসন চালালে সেটা ‘প্রলয়ংকর যুদ্ধে’ পরিণত হবে।
গত মাসে জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি বলেছিলেন, লেবাননে সামরিক পদক্ষেপ নেবে বলে ইসরায়েল যে হুমকি দিচ্ছে, সেটা ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’। সত্যি সত্যি যদি ইসরায়েল পূর্ণমাত্রার সামরিক আগ্রাসন শুরু করে, তাহলে সেটা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে রূপ নেবে।
সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক বেড়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি রকেট ও মিসাইল হামলা চলেছে। এগুলো প্রতিশোধমূলক হামলা যা কিনা বড় পরিসরে আঞ্চলিক সংঘাত সৃষ্টির উদ্বেগ তৈরি করছে।
এ ছাড়া ইসরায়েল ও ইয়েমেনের হুতিদের মধ্যেও উত্তেজনা বেড়েছে। গত সপ্তাহে দুই পক্ষ নাটকীয়ভাবে আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। গত সপ্তাহে হুতি তেল আবিবে যে হামলা চালায়, তাতে একজন নিহত ও দশজন আহত হন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। এই উত্তেজনা অন্যান্য দেশের ওপরও প্রভাব ফেলছে। কেননা, হুতিরা আক্রমণ বাড়ানোয় সামুদ্রিক জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। নভেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত হুতিরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী ৬০টি জাহাজে হামলা করেছে। ইসরায়েলে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোর ওপর স্পষ্ট হুমকি তৈরি করা হয়েছে।
এ ঘটনা আঞ্চলিক উত্তেজনা এমন মাত্রায় বাড়াচ্ছে যে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে গুরুতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জাহাজগুলো বিমা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সেগুলো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
ইরানের নেতারা তাঁদের প্রক্সিদের পেছনে খুব বেশি সময় লুকিয়ে থাকতে পারছেন না। তাঁরা স্পষ্ট করেছেন যে তাঁদের প্রক্সিদের বিরুদ্ধে যেকোনো হামলা হলে তার কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। এদিকে ইসরায়েলি নেতারা বিশ্বাস করেন যে এই উত্তেজনার পেছনে ইরান রয়েছে।
তেহরানের লক্ষ্য হলো, মধ্যপ্রাচ্যের আরও দেশে প্রভাব বাড়ানো। গত সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘তেহরান আমাদের সঙ্গে সাতটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি, ইরাক ও সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং পশ্চিম তীর ও ইরানও রয়েছে।’
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা যেকোনো সময়ই বড় কোনো যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারে। সে রকম কিছু ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিপদে পড়বে। যেকোনো মূল্যে সে রকম পরিস্থিতি এড়ানো দরকার।
ইরান ও ইসরায়েলের ছায়াযুদ্ধ কয়েক মাস আগে সীমিত আকারের সরাসরি সংঘাতে পরিণত হয়েছে। গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিকদের আবাসনে আকস্মিক হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ক্রপসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন, যা দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার মাত্রা বৃদ্ধি করে। প্রতিশোধ হিসেবে দুই সপ্তাহ পর ইসরায়েলের একটি জাহাজ জব্দ করে এবং ইসরায়েলের ভূখণ্ডে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। এর জবাবে ইরানের ইসপাহান শহর ও সিরিয়ায় বিমান হামলা করে ইসরায়েল।
এসব ঘটনাপ্রবাহ ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল একটা পরিস্থিতির দিকে নির্দেশ করে। ইচ্ছা না থাকার পরও যেকোনো পক্ষের একটি পদক্ষেপ কিংবা ভুল ডেকে আনতে পারে ধ্বংসযজ্ঞ।
এরপরও বছরের পর বছর ধরে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশ সীমিত মাত্রায় সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এবার আরও বড় মাত্রায়, আরও তীব্র সংঘাত শুরুর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কৌশলগত ও রাজনৈতিক—দুই দিক থেকেই পূর্ণমাত্রার সংঘাতে জড়িয়ে পড়া ইসরায়েল কিংবা ইরান কোনো দেশেরই স্বার্থ নেই। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।
ইসরায়েলের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে যে পূর্ণমাত্রায় সংঘাত শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবকে সমর্থন দেবে কি না। কেননা, বাইডেন প্রশাসন উত্তেজনা প্রশমনের কথা বলে আসছে। ইসরায়েলে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলার পর বাইডেন প্রশাসন তেল আবিবকে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছিল। একই সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যদি বড় কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, সেটা নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে ইরান সরকার দেশের ভেতরের ও অর্থনৈতিক চাপের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেমন আছে, আবার বেকারত্বের সমস্যাও আছে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খুব কমসংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছেন, যেটা ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর ওপর জনগণের অসন্তোষের প্রকাশ। আবার ইসরায়েলের কাছে শত শত পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে ধারণা করা হয়। সামরিক দিক থেকে ইরানকে এ বাস্তবতাও বিবেচনা করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইরান সরকারের কাছে ইসরায়েলের সঙ্গ যুদ্ধ জড়ানোয় কোনো স্বার্থ থাকার কথা নেই।
অন্য কথায়, কৌশলগত ও রাজনৈতিক দুই বিবেচনায়ই বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান ও ইসরায়েলের সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর কথা নয়। যাহোক, দুই দেশ যদিও সরাসরি সংঘাতের চেয়ে ছায়াযুদ্ধকেই বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারপরও এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং সরাসরি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। ইতিহাস বলছে, এ ধরনের প্রক্সি সংঘাত সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।
উদাহরণ হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা বলা যায়। প্রথম দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সীমিত মাত্রার সংঘাত দিয়ে শুরু হয়েছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সংঘাত বাড়তে বাড়তে এমন সর্বাত্মক যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যায় যে পরাশক্তিগুলো তাতে জড়িয়ে পড়ে এবং উল্লেখ করার মতো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিণতি ডেকে আনে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা যেকোনো সময়ই বড় কোনো যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারে। সে রকম কিছু ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিপদে পড়বে। যেকোনো মূল্যে সে রকম পরিস্থিতি এড়ানো দরকার।
মাজিদ রাফিজাদেহ, ইরানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
আরব নিউজ থেকে, ইংরেজি থেকে অনূদিত