মামদানি যেভাবে ট্রাম্পকে ট্রাম্পকার্ড দেখিয়ে দিলেন
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ০৮:১১ এএম, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫ আপডেট: ০৮:১১ এএম, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
কিছু মার্কিন গণমাধ্যম বলছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান কে মামদানির সাক্ষাৎটা নাকি ‘ব্রোম্যান্স’। কথাটায় হয়তো বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু তাঁদের সাক্ষাৎটা এতটা মধুর পরিবেশে হবে, এটাই বা কে ভেবেছিল!
এই সাক্ষাৎ রিপাবলিকান কর্মীদের যেমন বিস্মিত করেছে, তেমনই হয়তো ডেমোক্র্যাট শীর্ষ নেতাদেরও হতবাক করে দিয়েছে।
ট্রাম্প আগে মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’, ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ আর ‘উন্মাদ’ বলেছিলেন। কিন্তু শুক্রবারের হোয়াইট হাউস বৈঠকের আগে ট্রাম্প হঠাৎ বলেন—তিনি আশা করছেন সাক্ষাৎটা ‘ভদ্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ’ হবে।
তার মাত্র এক দিন আগে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট সাংবাদিকদের বলেছিলেন: ‘এটা অনেক কিছু বলে দেয় যে কাল হোয়াইট হাউসে একজন কমিউনিস্ট আসছেন; কারণ, ডেমোক্র্যাটরা তাঁকেই দেশের সবচেয়ে বড় শহরের মেয়র বানিয়েছে।’
সিএনএন জানায়, শুক্রবার সকালেই রিপাবলিকান সিনেটর রিক স্কট মামদানিকে ‘আক্ষরিক অর্থেই কমিউনিস্ট’ বলেছিলেন। রিক স্কট বলেন, মামদানি ‘হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন ট্রাম্পের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে।’
রিপাবলিকানরা কয়েক সপ্তাহ (এমনকি কয়েক মাস ধরে) চেষ্টা করছিলেন মামদানির রাজনীতিকে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে জুড়ে দিতে। ডেমোক্র্যাটরাও এই অভিযোগকে ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ, অনেকেই তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে দ্বিধা করছিলেন।
সিএনএনের ভাষায়—‘এটা ছিল রিপাবলিকানদের বড় সুযোগ। ট্রাম্পের এজেন্ডা আর ডেমোক্র্যাটদের তথাকথিত কমিউনিজমের মধ্যে তফাৎ দেখানোর সুযোগ...কিন্তু ট্রাম্প নিজেই তাদের এই কৌশল নষ্ট করে দিলেন।’
ট্রাম্প রিপাবলিকানদের আরেকটি বড় অভিযোগও বাতিল করে সবাইকে চমকে দেন। অভিযোগটি হলো—মামদানি নাকি ‘জিহাদি’। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি রিপাবলিকান নিউইয়র্ক গভর্নর প্রার্থী (কট্টর ইসরায়েলপন্থী কংগ্রেসওমেন) এলিস স্টেফানিকের এ দাবি মানেন?
ট্রাম্প বললেন: ‘না, আমি মানি না।’ তিনি বললেন, এটা স্রেফ নির্বাচনী বক্তব্য।
ট্রাম্প মামদানির জয়েরও প্রশংসা করেন। বলেন, তিনি ‘কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের’ হারিয়ে জয়ী হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, নতুন মেয়র রিপাবলিকানদের তাঁর নীতি দিয়ে অবাক করে দেবেন। শুধু তাই নয়, মামদানিকে সাংবাদিকেরা যখন তাঁর প্রচারণার কিছু মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করেন (যার মধ্যে ছিল ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা), তখনো প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘রক্ষা’ করেন। এতে বোঝা যায় ট্রাম্পের অবস্থান সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।
তাহলে কেন এই পরিবর্তন?
নিউইয়র্কের একজন দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষক খানিকটা মজা করে আমাকে বলেছেন, হয়তো মামদানি পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের কায়দায় ট্রাম্পকে ‘ভদ্রতা দিয়ে বশ’ করেছেন। পরে তিনি সিরিয়াসভাবে বলেন, ট্রাম্প স্বভাবগতভাবে আত্মরতিমগ্ন বা ‘নার্সিসিস্ট’ এবং সুযোগ পেলেই দুর্বলকে হেনস্তা করার মতো লোক।
মামদানির আবেগ-বুদ্ধি অত্যন্ত ভালো। তিনি হয়তো দুই দিকেই খেলেছেন। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ট্রাম্পের অহমবোধে স্পর্শ করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে ভয় দেখানো যাবে না।
ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েও মামদানি যে নরম নন—সেটা তিনি দ্রুতই দেখিয়ে দেন। সাংবাদিকেরা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি এখনো মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ‘গণহত্যায়’ সহায়তাকারী? মামদানি স্পষ্ট বলেন—ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তাতে অর্থ ঢেলেছে। তিনি আরও গর্ব করে বলেন: ‘আমি একজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’।
একই সময়ে মামদানি সব প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রধান যে নির্বাচনী ইস্যু, সেই নিউইয়র্কবাসীর জন্য ‘সাশ্রয়ী জীবনযাপন’-এর কথাই ধরে রাখলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আবার মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। তাই ট্রাম্প বাধ্য হয়ে মেনে নিলেন, জীবনযাত্রার খরচ এখন বড় সমস্যা। তিনি বললেন, নিজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণাতেও তিনি বারবার এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
মেয়র নির্বাচনের আগে ট্রাম্প নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল কাটার হুমকি দিয়েছিলেন। সাংবাদিকেরা এটি স্মরণ করিয়ে দিলে ট্রাম্প বিষয়টিকে ছোট করে দেখালেন। তিনি বললেন, তিনি মামদানিকে ক্ষতি নয়, সাহায্য করতেই মনোযোগ দেবেন, কারণ, ‘এ শহর আমরা দুজনেই ভালোবাসি’।
ট্রাম্প যদিও কয়েক বছর আগে ফ্লোরিডায় চলে গেছেন, তবু তিনি নিজেকে চিরদিনের নিউইয়র্কার ভাবেন। তিনি বললেন, তিনি মামদানিকে সমর্থন করবেন এবং মামদানি নিউইয়র্ক সিটিকে আবার মহান করতে চান।
আরেকজন বিশ্লেষক বলেন, ট্রাম্প এমন নেতাদেরই পছন্দ করেন, যাঁদের তিনি ‘শক্তিশালী’ মনে করেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বা বিশ্বের আরও কিছু নেতার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের এই মনোভাব দেখা গেছে। জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ওই তালিকায় আছেন।
বিশ্লেষকের মতে, মামদানিও এখন সেই শ্রেণিতে পড়ে, কারণ তিনি রিপাবলিকান পার্টি পুরোটা এবং ডেমোক্র্যাট দলের প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ে অসম প্রতিকূলতার মাঝেই জিতেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আরেকটি বিষয়ও আলোচনায় আছে। সেটি হলো, মামদানির দরজায় দরজায় প্রচারণার জন্য যে বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কাজ করেছে, তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। তাঁর মিডিয়া টিমও প্রথমবার ভোট দিতে আসা তরুণদের লক্ষ্য করে চমৎকার সামাজিক মাধ্যম বার্তা তৈরি করেছে।
পাশাপাশি মূলধারার গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছেও তাঁর বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
তবে ওভাল অফিসে যে উষ্ণ সম্পর্ক দেখা গেল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিডিয়াতে একটি বিষয় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। সেটি হলো—ট্রাম্পের নীতি ও আচরণ প্রায়ই ‘লেনদেননির্ভর’। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি খুব কঠোর, কারণ জেলেনস্কি তাঁর চোখে ‘করুণাপ্রার্থী’ বা ‘নির্ভরশীল’।
কিন্তু মামদানি তেমন নন। তিনি ট্রাম্পের ওপর নির্ভরশীল তো ননই, বরং কিছু ক্ষেত্রে ট্রাম্প তাঁর কাছে সহায়তা চাওয়ার মতো অবস্থানে আছেন।
ট্রাম্প, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, এবং জামাই জ্যারেড কুশনার—এঁদের সবারই নিউইয়র্ক সিটিতে কোটি কোটি ডলারের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে। এ বিষয়টিও হয়তো মামদানিকে ট্রাম্পের তোয়াজ করার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
কারণ, নিউইয়র্ক সিটিতে রিয়েল এস্টেট খাত নিয়ন্ত্রণ (যেমন জোনিং, অগ্নি ও নিরাপত্তা বিধি, বিল্ডিং লাইসেন্স দেওয়া, এমনকি সামাজিক আবাসন প্রকল্পের ঠিকাদারি) সবশেষে গিয়ে সিটি হলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। আর সিটি হল কার্যত মেয়রের নিয়ন্ত্রণেই থাকে।
তাই কুশনার, উইটকফ, তাঁদের পরিবার-বন্ধু-ব্যবসায়িক অংশীদাররা এবং ট্রাম্প নিজেও বুঝে গেছেন—সিটি হলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা কত জরুরি। রাজনৈতিক বক্তব্য বা দলীয় তর্ক এখানে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আব্বাস নাসির ডন-এর সাবেক সম্পাদক
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ