শেখ হাসিনাকে চাপ দিতে পারে, এমন কোনো চাপ নেই: প্রধানমন্ত্রী
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ১২:০৩ এএম, মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩ আপডেট: ১২:০৩ এএম, মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি কখনোই কোনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। তাঁকে চাপ দিতে পারে, এমন কোনো চাপ নেই। কারণ, তাঁর শক্তি জনগণ। আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
সাম্প্রতিক কাতার সফর নিয়ে সোমবার বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী কাতার সফরের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। এরপর তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংসদ নির্বাচন, কূটনীতিসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, নির্বাচন সামনে এলেই কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। কিছুদিন আগে আপনার দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে কিছু কূটনীতিক এসেছিলেন। গতকাল (রোববার) বিএনপি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা কূটনীতিকদের বলেছে, আপনার অধীনে ভোটে যাবে না। আরেকটা প্রশ্ন, নোবেলজয়ী ভাড়া করে বিবৃতি দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছেন কি না?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের একটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে শেখ হাসিনাকে চাপ দিতে পারে, এমন কোনো চাপ নেই। কারণ, আমার শক্তি একমাত্র আমার জনগণ। ওপরে আল্লাহ আছেন। আর বাবার আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় আছে। কাজেই কে কী চাপ দিল না দিল, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। জনগণের স্বার্থে যেটা করা দরকার, আমরা সেটাই করব। এ রকম বহু চাপ তো ছিল। পদ্মা সেতুর আগে তো কম চাপ দেওয়া হয়নি। ওই চাপে আমাদের কিছু আসে যায় না।’
ড. ইউনূস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ৪০ বিশ্বনেতার দেওয়া খোলাচিঠি নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যখন কাতারে ছিলেন, তখন ৪০ জন বিদেশি নাগরিকের একটি বিবৃতি বা আপিল করেছে, সেটা আপনি পেয়েছেন কি না জানতে চাই। সেটা ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। এই বিবৃতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য আশা করছি।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি একটা ভুল করছেন, সেটা ঠিক বিবৃতি না। এটা একটা অ্যাডভার্টাইজমেন্ট (বিজ্ঞাপন)। ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে। এর উত্তর কী দেব জানি না। তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে, সেটা হলো যিনি এত নামীদামি, নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত, তাঁর জন্য এই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন? তা–ও আবার বিদেশি পত্রিকায়। প্রজ্ঞাপন কেন দিতে হলো?’
দেশে কতগুলো আইন আছে, সে অনুযায়ী সব চলে এবং চলবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। আমরা শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করি। যারা ট্যাক্স ঠিকমতো দেয়, সেটা আলাদা বিভাগ আছে, ট্যাক্স আদায় করে। কেউ যদি এখন এ সমস্ত বিষয়ে কোনো রকম আইন ভঙ্গ করে বা শ্রমিকদের কোনো অধিকার কেড়ে নেয়, শ্রম আদালত আছে, সেটা দেখে। এ ক্ষেত্রে আমার তো কিছু করার নেই সরকারপ্রধান হিসেবে। কাজেই এখানে আমাকেই–বা কেন বলা হলো। এর বাইরে আমি আর কী বলব। পদ্মা সেতু কিন্তু করে ফেলেছি। খালি এটুকু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।’
কার সঙ্গে সংলাপ?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ না করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সময় টেলিভিশনের সহযোগী বিশেষ প্রতিনিধি দেবাশীষ রায় প্রশ্ন করেন, মাঠে এখনো বলা হচ্ছে আপনি আবারও সংলাপ করবেন। হয়তোবা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বসবেন। আপনার জোট নিয়ে যে পরিকল্পনা বা আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেগুলো নিয়ে কোনো ধারণা দেবেন কি না?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংলাপ কার সঙ্গে করব? হ্যাঁ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি সংলাপ করেছি। তার ফল কী? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ৩০০ আসনে ৭০০ মনোনয়ন দিয়ে টাকা খেয়ে নিজেরাই নিজেদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে, তারপর নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিয়েছেন, সহ্যশক্তি দিয়েছেন। নইলে ১৫ আগস্ট আমার বাবা–মার হত্যাকারী, গ্রেনেড হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা, বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা যারা করেছে, আমি তাদের সাথেও বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে। শুধু তাই না, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেল। আমি গেলাম একজন সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাতে। আমাকে কীভাবে অপমানটা করল। এত অপমানের পরও তাদের সাথে আবার কিসের বৈঠক?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ পারবেন আপনার বাবা–মার হত্যাকারীর সাথে বসে বৈঠক করতে? আপনাকে কেউ যদি এভাবে অপমান করে, আপনারা পারবেন? কে পারবে? যেটুকু সহ্য করেছি শুধু দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে; নিজের স্বার্থে নয়।’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসায় থাকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারপরও তো অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ…। তাঁর বোন এসে, ভাই এসে, বোনের জামাই সবাই এসে যখন আমার আর রেহানার (শেখ রেহানা) কাছে এসে আকুতি করল…। হ্যাঁ, তার (খালেদা) সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকা এবং চিকিৎসার সুযোগটা করে দিয়েছি। এটুকু যে করেছি, সেটাই যথেষ্ট। যারা বারবার আমাদের হত্যা করে, অপমান করে…। সারা দেশে কাকে না অপমান করেছে। তারপরও যে এটুকু সহানুভূতি পাচ্ছে, সেটা শুধু আমার কারণে।’
‘নইলে এদের সাথে কিসের বৈঠক, কিসের কী। আর কী ক্ষমতা তাদের আছে। সন্ত্রাস করা ছাড়া তো আর কোনো ক্ষমতা নেই’, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
হয়তো সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ব্যাপারে অনেকের কাছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে। অনেক সময় এ সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করে না। যেহেতু করোনা দেখা দিল, তখন একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকের ছিল যে এটা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব কি না। আমি কিন্তু বলেছি, আমরা পারব। যে কারণে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এটা অনুমোদিত হয়ে গেছে। কাজেই আমরা সেই সুযোগ নিয়েছি।’
এখন দেশ এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর মাঝে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে। ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিরও চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটাকে কিছু করতে পারব। হয়তো সাময়িক কিছু একটা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। সেটা মোকাবিলা করবে আমাদের জনগণ।’
জন্মই তো অস্ত্র হাতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাতে
নিউজ২৪ টেলিভিশনের সাংবাদিক শাহ আলী জয় বলেন, সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ভারতীয় উলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) নেতা অনুপ চেটিয়ার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, উলফার কার্যক্রম তাঁরা যে বাংলাদেশে চালিয়েছেন, তা তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে। বাংলাদেশে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র এসেছিল, তা সেই সরকারের মদদেই দেশে এনেছিলেন ভারতে পাচারের জন্য। বিষয়টি ভারতীয় গণমাধ্যমও সংবাদটি করছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে দাবি করছেন। তাঁদের এ দাবি কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে করেন?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেটা হাতেনাতে ধরা পড়ল ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্র পাচার হচ্ছে। যে পুলিশ ধরেছে, তাকে নির্যাতন করল, চাকরি থেকে বের করে দিল। তাহলে এটা শুধু রাজনৈতিক হয় কীভাবে। আর এই ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় কিন্তু তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত এবং খালেদা জিয়ার মন্ত্রীরাও সাজাপ্রাপ্ত। তারপরও যদি তারা এটাকে রাজনৈতিক বলে, তাহলে তো এটা জনগণই বিচার করবে। এটা তো ভাঁওতাবাজি, জনগণের সঙ্গে মুনাফেকি করা। কারণ, অস্ত্র চোরাকারবারিই তাদের ব্যবসা। সেটাকে তারা রাজনৈতিক হিসেবে দেখাতে চায়।’
বিএনপির পাচার করা ৪০ কোটি টাকা উদ্ধার করে দেশে আনা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরাসরি অস্ত্র চোরাকারবারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। গ্রেনেড হামলা, ওটাও তো রাজনৈতিক। হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে অনেককে হত্যা করতে চেয়েছিল, এই তো? এই তো ভালো, সবই রাজনৈতিক বলে ধামাচাপা দেওয়া। ওরা রাজনীতির কী জানে। রাজনীতির মধ্য দিয়ে জন্ম না তো। জন্ম তো অস্ত্র হাতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাতে। সেটা মনে রাখতে হবে সবাইকে।
চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলতে
কাতার সফর বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার পর প্রশ্নোত্তরপর্ব শুরু হলে প্রথমেই প্রশ্ন করেন একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু। তিনি বলেন, দেশি–বিদেশি গণমাধ্যম জানতে চায়, গত ১৫ বছরে অর্থনীতি, জীবনযাপনের মান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের যে ট্রান্সফরমেশন হয়েছে, তার তুলনামূলক চিত্র যদি আমাদের কাছে থাকে, তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দিতে পারব। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা তুলনামূলক চিত্র তৈরি করেছিলাম। ২০০৬ সালে কী ছিল, আমরা এখন কী করতে পেরেছি।’ গণমাধ্যমকর্মীদের সেটা দেওয়ার জন্য বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।” আমার অবস্থা সে রকমই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলতে। একসময় বাংলাদেশ শুনলেই মনে করত যে দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা–খরার দেশ। এখন আর সেটা কেউ মনে করে না। এখন বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে করে। একটানা ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করতে পেরেছি, একটা স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছি। এর মধ্যে ঘাত–প্রতিঘাত, অগ্নিসন্ত্রাস অনেক কিছু এসেছে। তারপরও একটানা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।’