ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪  |  Saturday, 20 April 2024  |  এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

মানুষের চাওয়ার সঙ্গে বাজেটের অসঙ্গতির কারণ


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ০৪:০৫ পিএম, মঙ্গলবার, ২ মে ২০২৩   আপডেট:   ০৪:০৫ পিএম, মঙ্গলবার, ২ মে ২০২৩  
মানুষের চাওয়ার সঙ্গে বাজেটের অসঙ্গতির কারণ
মানুষের চাওয়ার সঙ্গে বাজেটের অসঙ্গতির কারণ

বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ বেশ ভীতির মধ্যেই আছে। কারণ, আইএমএফের ঋণের বিভিন্ন শর্ত এবং সরকারের আর্থিক খাতে দুর্বলতা।সবারই মূল বক্তব্য, এত দিন যা বাজেট হয়েছে, তা কখনোই জনগণের জন্য হয়নি, বরং বাজেটে বড়লোকদেরই সাহায্য করা হচ্ছে। এর ফলে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকাতে বরং তা কখনোই পূরণ হয়নি। গত বাজেটের পর সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) এ কথাটাই বলেছিল যে, বাজেটে সব সুযোগ-সুবিধা বড় ব্যবসায়ীরাই পাচ্ছেন।

এখন মানুষের চাওয়া কী কী? তাদের চাওয়া, মূল্যস্ফীতি কমানো, চাকরির বাজার বৃদ্ধি, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখা। তাদের এই বাজেটের দরকার নেই, যেখানে বড়লোক আরও বড়লোক হচ্ছে, মধ্যবিত্ত হচ্ছে গরিব। কিন্তু এসব ছোট চাওয়াই আমাদের পূরণ হয় না। খুব কি বেশি চাওয়া?

আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুসারে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। আমাদের বাজেটে সব সময় উচ্চাভিলাষী জিডিপি ধরা হয়, এই বাজেটে উচ্চাভিলাষী জিডিপি না ধরে বাস্তবতা ধরে, যদি আগের থেকে কমে কমুক, তাহলে অনুপাতও কিন্তু কিছুটা বাড়বে। তাহলে সরকারেরও মানুষের ওপর চাপ বাড়াতে হয় না। সরকারের বোঝা উচিত, এ বছর নির্বাচন। তাই এ সময় অর্থনৈতিক কাজ অনেক স্থবির থাকে। আমাদের বাস্তবতার মাটিতে পা দেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই।

আইএমএফের বেশির ভাগ শর্তই থাকবে থিওরিটিক্যাল। সাধারণ মানুষের অবস্থা বোঝার দায়িত্ব সরকারের। সরকার দেশের আসল সমস্যাগুলোতে হাত না দিয়ে এখনো বিদ্যুৎ আর সারের দাম বাড়ানোয় ব্যস্ত। তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেলেও তা আমাদের দেশে কমছে না। এদিকে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানো যেত বিদ্যুৎ খাতের অসম চুক্তিগুলো বাতিল করে। কিন্তু সব দায় এখন আমাদের ঘাড়েই পড়ছে। কৃষিতে যদি সরকার ভর্তুকি না দেয় অথবা সিন্ডিকেটকে আগের মতোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়, বাড়তি বিদ্যুৎ, তেল এবং সারের দামের জন্য খাদ্যশস্যের দাম আরও বাড়বে। একমাত্র উপায়, সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দেওয়া, যে ইচ্ছা কারও নেই।

আমাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আগে সমস্যা চিহ্নিত করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, ঋণখেলাপিদের বাঁচানোর জন্য খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাই বদলে ফেলা হয়েছে। আমরা চাই সব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য আর ডেটা। সরকার যদি নিজেরাই লুকায়, ভেতরের অশুভরা দেশটার ভেতরের সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। তাই ঋণখেলাপি কমানোর পরিষ্কার পরিকল্পনা থাকতে হবে। আর ‘বিবিএস’কে ঢেলে সাজাতে হবে। তাদের কোনো তথ্যই মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, তাদের বিশ্বাসের জায়গাতে নিয়ে আসতে হবে।

আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত, বিদেশিরা যে টাকা ঋণ দেয়, সেই টাকা নিজেদের ঠিকাদার দিয়ে নিয়ে যায়। বাস্তবতা তার থেকেও খারাপ। বণিক বার্তার খবরে এসেছে, সরকার চীন থেকে ঋণ পেয়েছে ৭ বিলিয়ন; কিন্তু তাদের সারা দেশে ঠিকাদারি দিয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলার। এ রকম সব ক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা কোথায়? এত এত বড় মেগা প্রজেক্ট থেকে আমাদের দুই-তিনটা কোম্পানি প্রস্তুত হতে পারত না বিদেশে গিয়ে কাজ করার? এ রকম অবস্থা সব ক্ষেত্রে। গত বাজেটে ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে খুব বেশি ছাড় দেওয়া হয়নি। তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত। মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের নতুন রেজিস্ট্রেশনে যেখানে ৯০ শতাংশের ওপর এসএমই খাত। আমাদের কতটুকু?

সবার এক বাক্যের কথা, করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ করতে হবে। সরকারের আয় তো তাহলে কমে যাবে। উপায় কিন্তু নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে। আগে উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য ৩০ শতাংশ ট্যাক্সের একটা ভাগ ছিল, যা কোনো একটা অদ্ভুত কারণে সরকার বাদ দিয়ে দিয়েছিল। ফলাফলে মধ্যম আয়ের মানুষদের অনেক বেশি ট্যাক্স দিতে হয়েছে। ৫ লাখ নিম্নসীমা করে যদি ৩০ শতাংশের আগের ভাগ নিয়ে আসা যায়, তাহলে আয় কিন্তু কমবে না। মানুষের আর একটা দাবি, যেসব ক্ষেত্রে ডবল ট্যাক্সেশন হয়, তা বাতিল করতে হবে। এই ডাবল ট্যাক্সেশন আয়কর আইনের পরিপন্থী।

আইএমএফের মতে, আমাদের ১৫ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স বাড়ানো লাগবে। আমাদের সড়কপথে যে চাঁদাবাজি হয়, সে টাকা দিয়েই বছরে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। বাকি দুর্নীতি না হয় বাদই দিলাম। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।

ভারতে যে ট্রানজিট দেওয়া হলো, এত সস্তায় কোনো দেশ কি অন্য দেশকে তা  দেয়? এখানে যে দর–কষাকষির সুযোগ ছিল তা সম্ভবত কাজে লাগানো হয়নি। আমরা একটা বড় রাজস্ব পাওয়ার জায়গা হারালাম। এ রকম বাজে দর কষাকষি হয়েছে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে, কোনো তেল গ্যাস দেওয়ার জন্য বা কোনো মেগা প্রজেক্টেও। সে জন্যই বিশ্বের সব থেকে দামি এবং বাজে রাস্তা হয় বাংলাদেশেই। এই যে সুদের বোঝাতে পড়ছি, তা-ও বাজে পরিকল্পনার ফল। তাহলে আমাদের এসব বড় সরকারি কর্মকর্তারা কী করেন, যাঁরা এ জন্য দায়ী? আমাদের মন্ত্রী বলেছেন, বিদেশে যাঁরা বেগমপাড়া করেছেন, বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা। আজ পর্যন্ত তো একজনকেও ধরা হলো না। কেন? আমাদের যে গত ১২ বছরে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপর পাচার হওয়া টাকা, এতগুলো প্রতিষ্ঠান ধরার জন্য কাজ করছে, জবাবদিহি কোথায় সেসব প্রতিষ্ঠানের? তারা তো আমাদের ট্যাক্সের টাকাতেই বেতন নেয়। নাকি ধরে নেওয়া হবে ‘শর্ষের ভেতরেই ভূত’।

কিছুদিন আগে নিউমার্কেটের এক পোশাক ব্যবসায়ী গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার পর হিসাব করে বলছিলেন, ‘আমরা যদি ভারত থেকে পোশাক নিয়ে আসি, তাহলে লাভ বেশি হবে।’ এ রকম দাম বেড়েছে সব প্রোডাকশন লাইনের। আমাদের বড় দুর্বলতা আমাদের কাঁচামাল বাইরে থেকে আসে, তাই দাম বেশি হয়ে যায়। বাজেটে কাঁচামাল উৎপাদনে জোর দেওয়া উচিত এবং কর ছাড় দিয়ে উৎপাদনে সহায়ক আইন করা উচিত। নইলে কখনো দাম কমানো সম্ভব নয়।

নতুন বাস্তবতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় আর লাক্সারি পণ্যের সংজ্ঞা বদল হয়েছে। কিন্তু এখনো সেই আগের তালিকা অনুসারে ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ করা হয়, যা ভোক্তাদের জন্য কষ্টকর। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অবশ্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রতিটি পর্যায়ে ভ্যাট-ট্যাক্স সরিয়ে দিয়ে মানুষের কষ্ট লাঘব করা উচিত। দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য গ্রিন ব্যবসাতে প্রণোদনা এবং গ্রিন ট্যাক্স চালু করা উচিত। আর দাম বাড়ানো উচিত সিগারেটসহ যত ক্ষতিকর দ্রব্যাদি আছে সেসবের।

আমাদের সব থেকে প্রয়োজনীয় দুটি খাত—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ২ শতাংশের মতো, কিন্তু ইউনেসকো দিতে বলছে ৭ শতাংশ। আমাদের শিক্ষার মানের যে বেহাল, তা বড় কর্মকর্তাদের দর কষাকষি দেখলেই বোঝা যায়। তাঁরা দেশের অন্যতম সেরা ছাত্র, অন্যদের অবস্থা তাহলে কী?

এই বাজে দশার জন্যই লাখ লাখ বিদেশি আমাদের এখানে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর আমাদের সরকার সেটা শক্ত করতে একেবারেই নারাজ। সে রকম, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম, যা যেকোনো ভাবেই কম। এই খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ হওয়া উচিত অন্তত ৫ শতাংশ। প্রতিটি জেলাতে মেডিকেল কলেজ করছেন, সঙ্গে আমাদের আন্তর্জাতিক মানের অন্তত একটা হাসপাতাল জরুরি। বড়লোকেরা নাহয় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন, আমাদের বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ কোথায় যাবে?

এদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পেনশনের খরচ দেখিয়ে দিয়ে বরাদ্দ বেশি দেখানো হয়। কিন্তু তা ছাড়া বরাদ্দ ১ শতাংশ নয়। এটাও অন্তত পেনশন বাদেই ৪ শতাংশতে নিয়ে যাওয়া উচিত। ভর্তুকি কমালে আমাদের নিরাপত্তা বাড়ানো উচিত। সেই সঙ্গে আমাদের উদ্ধারকারী দলগুলোর (ফায়ার সার্ভিস) সক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

মানুষ ট্যাক্স দেয়। কিন্তু যাঁরা ট্যাক্স দেন, তাঁদের কী সুবিধা আছে? তাঁদের কিছু হলেও তো কোথাও সুবিধা দেওয়া উচিত? দেশের মোট ট্যাক্সের ৯০ শতাংশের ওপর আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু সব সুবিধা যায় সরকারি খাতে। মানুষ কেন তাহলে ট্যাক্স দিতে অনুপ্রাণিত হবে? সরকার যে সর্বজনীন পেনশন চালু করতে চাচ্ছে, তা বাড়তি বোঝা না করে প্রদেয় ট্যাক্সের অনুপাতে চালু করতে পারে। আশা করি এ ব্যাপারে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকবে।

আমাদের বাজেটে বিগত অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। আর তা অবশ্যই করতে হবে কোনো ‘বিগ ফোর’ অডিট ফার্ম দিয়ে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে। দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এত লুকানোর তো মানে নেই। আর দুর্নীতি কমাতে গেলে আমাদের অন্তত আগামী পাঁচ বছর সব মন্ত্রণালয়ের নিরপেক্ষ অডিট করা দরকার। আর নিরপেক্ষ অডিট হলে মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতারও আইডিয়া পাওয়া যাবে।

সরকারি ব্যয় খাতে ভর্তুকি, সুদের পর আর একটি বড় খাত বেতন-ভাতা এবং পরিচালনা খরচ। সব অবশ্যপ্রয়োজনীয় খাত রেখে বাকি খাত পর্যায়ক্রমে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ‘ডেসকো’ এ রকম একটা সফল উদাহরণ। তাদের সার্ভিসের খুব বেশি সমালোচনা নেই। সবাইকে দিয়ে দেওয়া উচিত নিজের খরচ নিজের আয় থেকে বহন করা। বিশ্বের অনেক দেশে এ রকম ব্যবস্থা আছে। নিজেদের খরচ নিজেদের তুলতে হলে জবাবদিহি আসবে, কমবে দুর্নীতি, অপচয় কমবে আর মানুষ পাবে ভালো সার্ভিস। সরকারকেও বাজেটে এই বিশাল খরচের বোঝা টানতে হবে না।

পরিশেষে, পত্রিকা মারফত জানা যায়, এবার সরকারি চাকরিজীবীদের ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতার প্রস্তাবনা আছে। এর মাধ্যমে কি মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ স্বীকার করে নেওয়া হলো না? বর্তমান বাস্তবতায় বেতন বাড়ানো জরুরি। কিন্তু সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের জন্যও পরিকল্পনা রাখা। দেশের এই ৯৫ শতাংশ মানুষ বড় অসহায় অবস্থায় আছে।

বাজেট নিয়ে আইএমএফ এখন কাটাছেঁড়া করছে। কিন্তু মানুষেরও চাহিদা, গতানুগতিক বাজেটের বাইরে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটা গণমানুষের বাজেটের শুরু এবার থেকেই হোক। কিন্তু শুরুটা করার কেউ কি আছে?

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট। মেম্বার, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। সাবেক মেম্বার, ট্রেড কমিটি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

সরকার অর্থনীতি পরিকল্পনা কর উন্নয়ন আয়কর বাজেট

আপনার মন্তব্য লিখুন...