ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন অযোগ্য, বাতিল করতে হবে: সমাবেশে বক্তারা
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ০৬:০৪ পিএম, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩ আপডেট: ০৬:০৪ পিএম, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩
জনগণের নিরাপত্তার জন্য নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে শাসকশ্রেণির নিরাপত্তার জন্য। এর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই আইন নিবর্তনমূলক। এটি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। বক্তারা বলেন, নামে ডিজিটাল হলেও এই আইন পশ্চাৎগামী৷ এই আইন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, এই আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং নওগাঁয় র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও বিচারের দাবিতে এই ‘ছাত্র জনতার সমাবেশে’ সভাপতিত্ব করেন আনু মুহাম্মদ। শিক্ষক, রাজনীতিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গবেষক ও ছাত্রনেতারা এতে বক্তৃতা করেন। বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এতে অংশ নেন।
সমাবেশে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জবরদস্তিমূলক শাসনের সহায়ক। এটা দুর্বৃত্ত ও লুটেরা গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য এ ধরনের আইন করা হয়েছে। এ রকম আইন আরও আছে।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচির সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য; তারা গিয়ে সংবাদপত্রের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মুখে কোনো অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ শোনা যায়নি। উল্টো প্রতিবাদ যাঁরা করছেন, তাঁদের দমন করার জন্য বিভিন্ন রকম সভা-সমাবেশ করছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে যেভাবে গভীর রাতে তুলে আনা হয়েছে, সেটা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, সম্প্রতি একটি পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল চাইছেন পদ ও নির্বাচনী মনোনয়নের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকা কিছু নায়ক-নায়িকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁদের গায়ে রাজার অদৃশ্য পোশাক। তিনি বলেন, ২০০ বছর আগে, ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে পত্রিকাগুলোকে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর আদালতে রিট আবেদন করেন। সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়। এর পেছনে অজুহাত ছিল, ভারতবর্ষ কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়৷ এখন যারা একটা সংবাদপত্রের নিবন্ধন বাতিল কিংবা টুঁটি চেপে ধরতে চাইছেন, তাঁরা বোধ হয় সেই পরাধীন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর তাঁবেদার।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা হারানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহর মতে, সরকার ও তাদের লোকজনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাতে কিছু বলা না যায়, সে জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। তিনি সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানান।
এই আইন পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি বলেন, বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিশ্বাসী মানুষেরা শুরুতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সরকার একগুঁয়েভাবে এটি প্রণয়ন করেছে। সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জন্যও এই আইনে মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার বাদী শাসক দলের নেতা-কর্মীরা।
সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এটা মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করছে। এটি স্পষ্টতই নিবর্তনমূলক আইন৷ এটি বাতিলের দাবিতে সবাইকে রাজপথে নামতে হবে।
লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা অদ্ভুত আইন, যে আইনে বেশির ভাগ মামলা হয়েছে মধ্যরাতে। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে করা মামলার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তারা চুরি-লুটপাট-নিপীড়ন করতে পারবে, সেগুলো বলা যাবে না৷ ভাতের কষ্টের কথা বলাও নাকি স্বাধীনতাবিরোধী! নিপীড়নমূলক এই আইন সংস্কার নয়, অবিলম্বে বাতিল করতে হবে৷ এই আইনের আওতায় যাঁরা জেলহাজতে কষ্ট ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে৷’
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হকের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, চিকিৎসক হারুন অর রশীদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীম আরাফাত প্রমুখ। সমাবেশে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তি।
সমাবেশে থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও বিচার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।