Oops! It appears that you have disabled your Javascript. In order for you to see this page as it is meant to appear, we ask that you please re-enable your Javascript!
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩  |  Thursday, 30 March 2023  |  এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

উগ্র জনতার চাপে কূটনীতি আর নেতাদের হাতে নেই


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ০১:০৩ এএম, বুধবার, ১ মার্চ ২০২৩   আপডেট:   ০১:০৩ এএম, বুধবার, ১ মার্চ ২০২৩  
উগ্র জনতার চাপে কূটনীতি আর নেতাদের হাতে নেই
উগ্র জনতার চাপে কূটনীতি আর নেতাদের হাতে নেই

যুক্তিনির্ভর ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির চর্চা কি এখনো সম্ভব? গেল সপ্তাহে মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনে জড়ো হওয়া রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, কূটনীতিক, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক পণ্ডিতদের সঙ্গে আলাপ করার পর এ প্রশ্নের জবাব নিয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছি।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের কথাই ধরা যাক। মাত্র এক মাস আগে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হি পশ্চিমাদের নিয়ে বেশ উষ্ণ রসিকতা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। অনেকে আশা করেছিলেন, পশ্চিমাদের বিষয়ে চীন যথেষ্ট ইতিবাচক অবস্থানে এসেছে।

গত নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের নির্ধারিত চীন সফর দুই দেশের উত্তেজনা অনেকখানি কমিয়ে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ভেস্তে গেল। 

আচমকা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের দানবাকৃতি বেলুন ভাসতে দেখা গেল। বাইডেন প্রশাসন বিষয়টিকে সহজভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। খুব দ্রুতই জনমত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেল। টেলিভিশন, টুইটার এবং অন্যান্য মাধ্যমে বাইডেনের সমালোচকেরা বাইডেনের ধৈর্যধারণকে দুর্বলতা হিসেবে দেখানো শুরু করলেন।

ফলে বাইডেন প্রশাসন চাপে পড়ল এবং ব্লিঙ্কেনের বেইজিং সফর বাতিল করা হলো। মার্কিন আকাশে বেলুনগুলো দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহ পর সেগুলোকে ধ্বংস করা হলো এবং এর জন্য চীনের নিন্দা করা হলো। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার ঘোষণা দিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ওড়া ওই বেলুনকে সে দেশের কর্মকর্তারা কোনো হুমকি হিসেবে দেখেননি। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারাই বলেছেন, এ ধরনের হাজার হাজার বেলুন আকাশে উড্ডয়নরত আছে এবং সেগুলো কোনো হুমকিও নয়। কিন্তু মার্কিন জনগণের চোখে নিজেদের শক্তিমত্তাকে জাহির করার প্রয়োজনে সেগুলোকে হুমকি হিসেবে বলা হয়েছে এবং তার খেসারত হিসেবে চীন–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উষ্ণতার দিকে গিয়েও আর যেতে পারেনি। দুই দেশের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে।

মিউনিখে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও অন্যান্য আমেরিকান বক্তারা বাকি বিশ্বকে তাঁদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিবিরে টানার চেষ্টা করেছেন এবং রাশিয়াকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে পুতিনের বিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের এই আহ্বান ইউরোপের অনেকের কাছে স্বাগত জানানোর মতো কথা হলেও, এই বাগাড়ম্বর বাকি বিশ্বের অনেককে একঘরে করে ফেলার হুমকিতে ফেলে দিতে পারে।

এই বেলুন ভূপাতিত করার ঘটনা জর্জ অরওয়েলের বার্মিজ ডেজ উপন্যাসে উল্লেখ করা ১৯২০–এর দশকে তৎকালীন বার্মায় অরওয়েলের গুলি করে হাতি শিকার করার অপূর্ব বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, তরুণ অরওয়েলের হাতে একটা বন্দুক তুলে দিয়ে একটা পাগলা হাতি মারার জন্য বলা হয়।

কিন্তু তিনি হাতিটার কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন, সেটি মোটেও পাগলা নয়, একেবারে শান্ত ও স্বাভাবিক। কিন্তু জনতার দাবির মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে হাতিটাকে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়। একটা পর্যায়ে তাঁর উপলব্ধি, ‘পূর্বদেশে একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবে আমাকে প্রতিনিয়ত জনগণের হাসির পাত্রে পর্যবসিত না হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে।’

আধুনিক কূটনীতির ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা যাচ্ছে। সেখানে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় গঠনমূলক কূটনীতি পরিচালনা করতে পারছেন না। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির নেতাদেরও সংবাদমাধ্যম ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় উন্মত্ত জনতার প্রচার প্রোপাগান্ডার সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য হতে হচ্ছে। 

সি চিন পিংয়ের পক্ষে সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যম ও অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের চাপ গায়ে না মাখা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও তিনিও প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চিও ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে তীব্র চাপ অনুভব করেন।

আজকালকার ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে যে কাউকেই অবশ্যই শক্তিধর সরকার ও তাদের শীর্ষ কৌশলের বাইরের জগৎকেও বুঝতে হবে। কারণ, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চালকের আসনে এখন শুধু সরকারের কর্মকর্তারাই থাকেন না, সেই আসনের অনেকখানি দখল করে নিয়েছে পাবলিক ওপিনিয়ন বা জনমত। এটি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সঞ্চারিত হওয়ার মতো প্রপঞ্চ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সাব–সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে অনলাইন সেবা পৌঁছে গেছে। এ কারণে সেখানকার জনগণও তাঁদের সরকারের সব কাজকর্ম দেখতে পাচ্ছেন এবং অনেক সময় তাঁদের ইচ্ছা–অনিচ্ছা সরকারকে মেনে নিতে বাধ্য করছেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষ বিশ্বকে যে চোখে দেখেন, বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষের দেখা তার চেয়ে একেবারে আলাদা। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের নতুন একটি জরিপে দেখা গেছে, ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ রাশিয়ার প্রতি আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন এবং ইউক্রেনকে তার হৃত ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। অন্যদিকে চীন, ভারত, তুরস্ক ও অবশ্যই রাশিয়ার মানুষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই যুদ্ধের সমাপ্তি চান, এমনকি এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পরাজয় হলেও।

মিউনিখে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও অন্যান্য আমেরিকান বক্তারা বাকি বিশ্বকে তাঁদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিবিরে টানার চেষ্টা করেছেন এবং রাশিয়াকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে পুতিনের বিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের এই আহ্বান ইউরোপের অনেকের কাছে স্বাগত জানানোর মতো কথা হলেও, এই বাগাড়ম্বর বাকি বিশ্বের অনেককে একঘরে করে ফেলার হুমকিতে ফেলে দিতে পারে।

অন্যদিকে ওয়াং বলেছেন, সব দেশেরই নিজ নিজ পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে; এমনকি ‘ইউরোপীয় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’কে চালাকিপূর্ণভাবে সমর্থন করার অধিকারও তাঁরা রাখেন। তিনি মিউনিখ সম্মেলনে যখন ইউক্রেনসংক্রান্ত শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, তিনি সম্মেলনকক্ষের ভেতর অবস্থানরত নেতাদের উদ্দেশে সে আহ্বান জানাচ্ছেন না, বরং গোটা বিশ্ববাসীর উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শান্তি আলোচনার মানে হলো, ইউক্রেনের একটি বিরাট অংশ রাশিয়ার হাতে চলে যাওয়া এবং সেটি কিয়েভের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। কিন্তু সেই আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে তিনি ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের দোষারোপ করার লক্ষ্য পূরণ করলেন।

এই নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে সব দেশের সব শাসকই, এমনকি স্বৈরশাসকেরাও জনতুষ্টিবাদের কাছে বন্দী হয়ে আছেন। ফলে সত্যিকারের কূটনীতি কোণঠাসা হতে হতে একেবারে কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক

মতামত থেকে আরও পড়ুন

কলাম ভূরাজনীতি চীন যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতি

আপনার মন্তব্য লিখুন...