ঢাকা, সোমবার ১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৭ | এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

আপনাকেই বলছি: ক্ষমতাবলে শিক্ষক হওয়া স্যার!


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ০১:০২ এএম, মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯    
আপনাকেই বলছি: ক্ষমতাবলে শিক্ষক হওয়া স্যার!
আপনাকেই বলছি: ক্ষমতাবলে শিক্ষক হওয়া স্যার!

জ্বী, আমিও ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া একজন ছাত্রী। কিন্তু না, আমি শিক্ষক হই নি এবং আমি প্রতীকের মতো কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যাও করিনি। আত্মহত্যা কেন করিনি সেটায় পরে আসছি, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে শিক্ষক কেন হইনি সেটা বলি আগে। আমি শিক্ষক হইনি কারণ আমি ছাত্রলীগ করতাম না এবং তখন জনৈক ছাত্রলীগ নেতার হঠাৎ করে খুব শখ হলো উনিও টিচার হবেন।

Surfe.be - passive income


উনি দেখলেন যে উনার শিক্ষার ঝুলিতে শিক্ষক হওয়ার মতো তেমন কিছু একটা না থাকলেও ক্ষমতা ছিল, উনার ঝুলিতে ক্ষমতাবলে জোর করে অন্যায়কে ন্যায় প্রমাণ করার মতো দক্ষতা ছিল, উনাদের ক্ষমতা ছিলো জোর করে অন্যের প্রাপ্য জিনিস অন্যায়ভাবে নিজের করে নেয়া। উনারা নকল করে, রাজনীতি করে কোনোরকম পরীক্ষা পাশ করতেন, কখনো বা আবার পাশও করতেন না। কিন্তু আমরা যারা সারাবছর কষ্ট করে পড়াশোনা করতাম মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য, ‘মেয়ে আমার ইউনিভার্সিটির টিচার হবে’, আমাদের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয় উনাদের মতো ছাত্রলীগের নেতার শখের কাছে। উনাদের কাছে যেটা শখ, আমাদের কাছে তা ছিল আমাদের নিজেদের আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। সেই ছাত্রলীগ নেতার শখের মূল্য দিতে হলো আমাদের রিক্রুটমেন্টের ইন্টারভিউ বোর্ডে ৩ ঘন্টা তালাবন্ধ অবস্থায় বসে থেকে।

আমার মাস্টার্সের রেজাল্টের পর আমাকে ডিপার্টমেন্টে ডাকানো হলো। আমি যাওয়ার পর টিচাররা আমাকে বললেন, “তুমি তো রেকর্ড করে ফেলেছো! তোমার আগে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের শিক্ষক নিখিল A পেয়েছিলো (নিখিল স্যার এখন আমেরিকার University of Tennessee, Knoxville এর PhD Candidate and Instructor), যেটা এতদিন কেউ বিট করতে পারেনি আর এখন একমাত্র তুমি তার স্কোর বিট করতে পারলে (যদিও জ্ঞান এবং যোগ্যতায় আমি নিখিল স্যার এর পায়ের কাছেও যেতে পারবো না)। উনাদের ভাষ্যমতে, আমি গোল্ড অথবা সিলভার মেডেল কিছু একটা পেয়ে যাবো হয়তো।

Surfe.be - passive income

আমাদের তখন জানা ছিলো না ছাত্রলীগ নেতার শখের মূল্যের কাছে রেকর্ড করা C.G.P.A কোনো ব্যাপারই না। বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিয়েও যখন নিয়োগের ইন্টারভিউ স্থগিত করতে পারলেন না উনারা, তখন ইন্টারভিউয়ের দিন আমরা কয়েকজন ক্যান্ডিডেট সহ ভিসি স্যারকে তালাবন্দ করে রেখে দেয়া হলো, যেনো ইন্টারভিউ বোর্ডের বাকি মেম্বাররা বোর্ড এ যেতে না পারেন। কারণ ছাত্রলীগের ওই নেতা জানতেন ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া উনি কোনোভাবেই টিচার হতে পারবেন না, কারণ টিচার হওয়ার জন্য যে মেধা, জ্ঞান এবং রেজাল্ট দরকার তার কোনোটাই উনার ছিলো না। জানতে ইচ্ছে করে এখন উনার ছাত্রছাত্রীরা না পড়ে আসলে তাদের কি আপনি তালাবন্ধ করে রেখে শাস্তি দেন? (পুনশ্চ: ২ বছর ইন্টারভিউ স্থগিত থাকার পর আমি সুইডেন আসার দুই মাসের মাথায় নিয়োগের ইন্টারভিউ হয় এবং যথারীতি মাননীয় নেতা নিয়োগপ্রাপ্ত হন)!

এই ছিল আমার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও শিক্ষক না হওয়ার গল্প। কিন্তু না, আমি শিক্ষক না হয়ে প্রতীকের মতো আত্মহত্যা করি নি, মন খারাপও হয় নি আমার। কেন জানেন? কারণ আমি কখনোই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চাইনি। আমি যখন প্রতি সেমিস্টারে ফার্স্ট, সেকেন্ড কিছু একটা হয়ে যেতাম, তখন থেকেই আমার মা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন যে মেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে আর আমি ভাবতাম যে বাবা মারা যাবার পর আম্মা আমাদের অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছেন, মায়ের জন্য নিজের স্বপ্ন তো বিসর্জন দেওয়াই যায়। আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নাই যে আমি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হইনি, আমার দুঃখ যে সামান্য ছাত্রলীগের নেতার শখের কাছে আমার মাকে তার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছে।

আমি সুইডেনে পড়তে আসার পর আমাকে অনেকেই বলেছেন যে আমি একেবারে পিএইচডি শেষ করে এসে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে পারবো। আমিও তাদের পাল্টা বলেছি, যে নেতামশাই ক্ষমতাবলে শিক্ষকতা পেশায় চলে আসছেন, তিনি আর যাই হন আমার কলিগ হবার যোগ্যতা রাখেন না। ভদ্রলোকের সাথে একই জায়গায় কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না! আমার মাঝেমধ্যে খুব জানতে ইচ্ছা করে কোনোরকম টেনেটুনে পাশ করা ছাত্র থেকে যে ঊনি ক্ষমতাবলে শিক্ষক হয়ে গেলেন, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর মতো জ্ঞান রাখেন তো উনি?

Surfe.be - passive income

জ্বী স্যার, আপনাকেই বলছি। নাম উল্লেখ করেই বলতাম, কিন্তু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে হয়তো আপনার ছাত্রছাত্রী আছে। তারা আপনার শিক্ষক হওয়ার গল্প জেনে গিয়ে কাল থেকে হয়তো আপনার মুখে থুথুও দিতে পারে, তাই আপনার সম্মানটা রাখলাম। আপনি নিজেও হয়তো জানেন না আমার ক্ষতি করতে গিয়ে কতো বড় উপকারটা আপনি করে দিলেন! ক্ষমতা বৈকি আপনার ঝুলিতে গত তিন বছরে আর কী যোগ হয়েছে জানি না, তবে আমার ঝুলিতে কী কী যোগ হয়েছে জানেন? আমি আজকে সুইডেনের প্রথম এবং বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের ১০০টা ইউনিভার্সিটির মধ্যে একটা থেকে গ্র্যাজুয়েট। আসছে স্প্রিংয়ে আমার একটা বই পাবলিশ হবে যেটা লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্র্যাড-এ একাডেমিক রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হবে। আরো শুনবেন? আমার এই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া রেজাল্টের জন্য ২০১৬ তে বাংলাদেশ থেকে দুইজন লুন্ড ইউনিভার্সিটি গ্লোবাল স্কলারশিপ পাওয়া স্টুডেন্টের মধ্যে ১০০% স্কলারশিপ পাওয়া একমাত্র স্টুডেন্ট আমি। ধন্যবাদ আপনাকে, যদিও আপনাকে আমি এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। ছাত্রাবস্থায় আপনার জ্ঞানের দৌড় কতটুকু ছিল, সেটা আমরা সবাই খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু যদি কখনো মনে করেন শিক্ষকতায় এসে আমার সাথে কথা বলার মতো যোগ্যতা এবং জ্ঞান অর্জন আপনার হয়েছে, তাহলে একদিন দেখা করবেন প্লিজ। আমি দেশে আসছি শীঘ্রই, আপনাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দিয়ে আমি আপনার উপকারের ঋণ শোধ করে দিবো। 

এই কথাগুলা ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি ছাত্র প্রতীকের মৃত্যুর কারণে লিখা। ওর মৃত্যু আমাকে তিন বছর আগের দিনগুলোতে নিয়ে গিয়েছিলো। বোকা ছেলেটা কষ্ট পেয়ে মরে গেলো, কিন্তু ও জানলো না ওর মতো অনেকেরই জীবিত থেকেও আত্মার মৃত্যু হয়েছে ক্ষমতার প্রহসনের কাছে। ভালো থাকিস ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুন...