‘বসন্তের কোকিল’, ‘দুধের মাছি’ এবং একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী!
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ০৭:০২ এএম, মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
‘বসন্তের কোকিল’ বলে একটা শব্দ আছে বাংলা অভিধানে, সুসময়ের বন্ধু বোঝাতেই ব্যবহার করা হয় এটা। মানুষের সময় ভালো থাকলে, হাতে টাকাপয়সা আর ক্ষমতা থাকলে আশেপাশে এমন বসন্তের কোকিলের অভাব হয় না। তবে বসন্ত কেটে গেলে কোকিলের মতো এরাও গা ঢাকা দেয়, বেরিয়ে পড়ে নতুন স্বার্থের সন্ধানে। এসব সুবিধাবাদী লোকজনকে চেনা যায় খারাপ সময়ে, কিংবা দরকার ফুরিয়ে গেলে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও যেমন এখন বসন্তের কোকিলদের চিনতে পারছেন। যখন তিনি মন্ত্রী পদে ছিলেন, তখন যে মানুষগুলো উঠতে বসতে তাকে তোয়াজ করতো, তিনি সিলেটে আসার আগেই বিমানবন্দরের সামনে উৎসব শুরু করে দিতো, এখন তাদের কেউই তার আশেপাশে নেই! মধু শেষ, তাই মাছিও উড়ে গেছে নতুন ভাণ্ডারের সন্ধানে!
কিন্ত সেই উপচে পড়া ভীড়ের বেশিরভাগটাতেই যে ছিল সুবিধাবাদী নেতাকর্মীরা, সেটা বোঝা গেল গতকাল। বিপিএলের খেলা দেখতে ঢাকা থেকে নিজের শহর সিলেটে এসেছিলেন মুহিত। এর আগে যখনই তিনি সিলেটে এসেছেন, এয়ারপোর্টের সামনে পা রাখার জায়গা হতো না। জেলায় একটা সাজ সাজ রব চোখে পড়তো, আঁতিপাতি নেতারা মুহিতকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে দিতো গোটা শহর।
সেই রাম এখন আর নেই, নেই অযোধ্যাও। তাহলে আর কেন এত বাড়তি পরিশ্রম? গতকাল মুহিত যখন সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলেন, তখন তাকে বরণ করার জন্যে আসেনি কেউই! তিনি যে সিলেটে এসেছেন, সেই খবরটাও হয়তো কেউ রাখার দরকার মনে করেনি। সাংবাদিকদের ভীড়টাও চোখে পড়লো না। রানওয়ে থেকে এভিয়েশনের এক কর্মী এবং ব্যক্তিগত সহকারীর সাহায্য নিয়ে হুইলচেয়ারে চড়ে বাইরে এলেন মুহিত, সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল না নেতা-কর্মীদের জটলা, শোনা যাচ্ছিল না মিছিলের শ্লোগান- যেগুলো কিনা গত দশ বছর ধরেই নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা ছিল মুহিতের জন্যে!
মুহিত চাইলে বাংলা সিনেমার অনেক পুরনো একটা গান তখন অনায়াসেই গাইতে পারতেন- ‘আমি একা, বড় একা; আমার আপন কেউ নেই…!’ তবে সাবেক অর্থমন্ত্রীকে একেবারে একা হতে দেননি এক ভদ্রলোক। তার নাম মাহি উদ্দিন আহমেদ সেলিম। বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির এই সদস্যই মুহিতকে নিয়ে গিয়েছেন স্টেডিয়ামে, সেখানে সিলেট বনাম ঢাকার ম্যাচ উপভোগ করেছেন মুহিত।
গত দশ বছরের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত যখনই সিলেটে এসেছেন, তাকে দেখার জন্যে, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্যে নেতাকর্মীদের ঢল নেমেছে। অনেকেই ইচ্ছেমতো তার নাম ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়েছে, অবৈধ সুবিধা নিয়েছে, নিজেরা সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে। মুহিতের সঙ্গে তোলা দু-চারটে ছবি দেখিয়ে হয়তো কেউ কেউ আখেরও গুছিয়ে নিয়েছে, মুহিত হয়তো সেসবের আগা-গোড়া কিছুই জানেন না।
স্রষ্টার নামে জপ করার মতোই কিছু মানুষ গত দশ বছর ধরে মুহিতের নাম জপেছে। কিন্ত আজ যখন তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন, রাজনীতি ছেড়ে অবসরে গিয়েছেন, তখনই তিনি সেই সুবিধাবাদী শ্রেণীর কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন। কারণ তারা এখন অন্য কারো নামে মালা জপে, নিজেদের আখের গোছানোর জন্যে মুহিতের পরিবর্তে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছে তারা এখন। এখানে ফ্যাক্টের নাম আবুল মাল আবদুল মুহিত নন, ফ্যাক্ট হচ্ছে ক্ষমতা, ফ্যাক্ট হচ্ছে রাজনীতি। যার কাছে ক্ষমতা আছে, দুধের মাছি’রা তার দিকেই ছুটবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
টানা দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকায় দেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ। দশ বছর আগে যে ছেলে শিবিরের রেজিস্টার্ড কর্মী/সাথী ছিল, সে-ও এখন কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কোন একটা পদে ঢুকে গেছে। আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুকে তিনবেলা যে লোক গালি দিতো, সে এখন পল্টি নিয়ে কোন একটা তরুণ লীগ বা শিশু লীগ গঠন করে ফেলেছে। প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা এখন এদের ভীড়ে কোণঠাসা। অবস্থাটা যে কি ভয়াবহ, সেটা সাবেক অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দেখেই বোঝা যায়।
দশটা বছর ধরে এই সুবিধাবাদী লোকগুলো তার চারপাশটা দখল করে রেখেছিল, আওয়ামী লীগকে যারা মন থেকে ভালোবাসে, তারাই হয়তো নেতাদের আশেপাশে যাওয়ার সুযোগ পেতো না, এখনও পায় না। কারণ সুবিধাবাদী এই গোষ্ঠীটা সারা দেশে, সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে। আওয়ামী লীগের শরীরে যে এরা ভাইরাসের মতো ঢুকে পড়েছে, সেটা আওয়ামী লীগের ভাবনায় আছে কিনা, দলের নীতিনির্ধারকেরাই ভালো বলতে পারবেন!