মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ১০:০৪ পিএম, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২ আপডেট: ১০:০৪ পিএম, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২
উন্নত বাংলাদেশের উপযোগী করে পুলিশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ বছর থেকে নতুন নিয়মে উপপরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে প্রার্থী নির্বাচন করা হচ্ছে। এসআই নিয়োগে প্রথমবারের মতো কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষা ইতিমধ্যে অুনষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ২ হাজার ৫৫০ জন। এসব প্রার্থীদের এবার মৌখিক ও বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা নেওয়া হবে।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সময়ের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই একজন চাকরিপ্রত্যাশীর প্রথম কাজ। লিখিত ও মৌখিক সব ক্ষেত্রেই নিজের মেধার প্রমাণ দিতে হয়। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান ও কম্পিউটার—সব বিষয় সমান জ্ঞান রাখতে হয়।
উপপরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে মৌখিক পরীক্ষার সুন্দর প্রস্তুতির জন্য এই ধাপকে চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
১. স্নাতকে পড়া নিজের বিষয়
২. নিজের সম্পর্কে ও জেলা
৩. বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ
৪. বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও সাম্প্রতিক বিষয়
উপরিউক্ত শিরোনামে চারটি নোট খাতা তৈরি করে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নোট করে রাখলে প্রস্তুতি দুর্দান্ত হবে আশা করি।
স্নাতকে পড়া নিজের বিষয়
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আপনাদের নিজের বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আপনি ইংরেজি বিষয়ে বিএ/এমএ করেছেন,কিন্তু উইলিয়াম শেক্সপিয়র বা জন কিটস সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ ধারণা না থাকা খারাপ। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
আপনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন কিন্তু ড. শামসুজ্জোহা, ইতরাত হোসেন জুবেরী বা প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে না পারলে বোর্ড বিরক্ত হবে। কিংবা আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন অথচ রাজু ভাস্কর্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না, এটা কাম্য নয়। তাই নিজের পঠিত বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনাকে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। অনেকেই নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালোভাবে বলতে পারেন না। যেমন, আপনি সরকারি এবিসি কলেজে পড়েছেন, এ ক্ষেত্রে আপনি বললেন সরকারি এবিসি কলেজ, এটা কিন্তু ভুল। কারণ, আপনাকে নাম বলতে হলে অবশ্যই সেটার পূর্ণাঙ্গ নাম বলতে হবে। আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম, তাঁদের বিখ্যাত কর্ম থাকলে তা সঠিকভাবে জেনে নেবেন।
নিজের সম্পর্কে ও জেলা
নিজ নামের অর্থ, নিজ নামের সঙ্গে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির নামের মিল আছে কি না, নিজ জন্মতারিখে অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মতারিখের মিল রয়েছে কি না, তাঁদের সম্পর্কে জানতে হবে। নিজের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং নিজের সবল ও দুর্বল দিক সম্পর্কে ধারণা। নিজ পরিবার সম্পর্কে গুছিয়ে বলার যোগ্যতা থাকতে হবে। নিজ জেলার অবস্থান, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা, বিখ্যাত ব্যক্তি, ঐতিহাসিক স্থান বা আপনার জেলা কেন বিখ্যাত, তার ধারণা রাখতে হবে। আপনার জেলায় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি থাকলে তাঁর নাম, ঠিকানা এবং কেন বিখ্যাত, তা জানতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ
জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে। প্রায় সব মৌখিক পরীক্ষায় এ বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে ভাইভা বোর্ড আপনার প্রতি বিরক্ত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জেনে নিতে হবে। সেক্টর কমান্ডার, সেক্টর, বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান, পুলিশে মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম, বীর বিক্রম বা বীর প্রতীক কেউ থাকলে তাঁর সম্পর্কে জানতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা জানতে হবে বিস্তারিত।
বঙ্গবন্ধু (মা, বাবা, তাঁর শৈশব, বই, স্কুল, কলেজ, রাজনৈতিক জীবন, তিনি কত দিন জেলে ছিলেন, তাঁর পোশাক, ৭ মার্চের ভাষণ, সেটা কত মিনিটের ছিল—এসব জানতে হবে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুখস্থ করতে হবে ইংরেজিতে)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিস্তারিত সব জানতে হবে। যেমন জন্ম, লেখাপড়া, কী কী উপাধি পেয়েছেন, সম্প্রতি যেসব পুরস্কার পেয়েছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের তাঁর ভূমিকা ইত্যাদি।
যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁদের কার কবে ফাঁসি হয়েছে, সে সম্পর্কে জানতে হবে। কিছু যুদ্ধপরাধীর নামের তালিকা ধরতে পারেন। এ ছাড়া বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ, দেশের গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, কবিতা ও গজল মুখস্থ করতে হবে।
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও সাম্প্রতিক বিষয়
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। যেমন মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু। করোনা মোকাবিলায় সরকারের সাফল্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ, মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে। সাম্প্রতিক বিষয়ের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটো সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
মৌখিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা
সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর বোর্ড বসার অনুমতি দিলেন।
বোর্ড: নাম কী, কাগজপত্র দাও!
আমি: নাম বললাম।
বোর্ড: নিজের সম্পর্কে কিছু বলো।
আমি: প্রশ্নটির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছিল এবং আমার উত্তরে ভাইভা বোর্ড সন্তুষ্ট মনে হলো।
বোর্ড: এরপর সরাসরি বিষয়সম্পর্কিত প্রশ্ন। সিএসইর মানে কী? কম্পিউটারের র্যাম ও রম কী?
আমি: স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দিলাম।
বোর্ড: স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্ন করলেন।
আমি: মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা থাকায় আমি সফলভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলাম।
বোর্ড: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খলিফা হিসেবে কারা পরিচিত?
আমি: তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, তৎকালীন ডাকসু সহসভাপতি ও ছাত্র ইউনিয়নের সিনিয়র সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন।
বোর্ড: ধন্যবাদ। আপনি আসুন।
আমি: ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম স্যার।
আপনারা যাঁরা মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাঁরা একটা কথা মনে রাখবেন। ইতিমধ্যে লিখিত ও কম্পিউটার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন। মেধাবী বলেই দুই ধাপ পার হতে পেরেছেন। আত্মবিশ্বাস রাখুন। মৌখিক পরীক্ষায়ও ভালো করবেন। সবার জন্য শুভকামনা।
মো. জাকির হোসেন, ৩৭তম সাব-ইন্সপেক্টর,
সমাজকল্যাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মৌখিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা
সালাম দিয়ে ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করি। আমার সার্টিফিকেটগুলো একজন বোর্ড মেম্বার আমার কাছ থেকে নিয়ে বসতে বলেন। ধন্যবাদ দিয়ে আমি বসি।
বোর্ড: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সাবজেক্ট এ পড়েছেন?
আমি: সমাজকল্যাণ ও গবেষণা।
বোর্ড: আচ্ছা আপনি তাহলে বলুন যে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে কীভাবে রিফর্ম করা যায়?
আমি: বেশ কিছু পয়েন্ট দেখিয়ে, যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক ও সামাজিক সাপোর্ট প্রয়োজনে কোটা ব্যবহার ইত্যাদি বলতে থাকি।
বোর্ড: আচ্ছা জনগণকে সচেতন করা দরকার নয় কি?
আমি: অবশ্যই দরকার স্যার, তবে মৌলিক অধিকারগুলো আগে পূরণ করা দরকার।
বোর্ড: আচ্ছা আপনাকে একটা কঠিন ট্রান্সলেশন জিজ্ঞাসা করি। বলুন তো, দক্ষিণ সুদান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।
আমি: South Sudan is a war devastated country
বোর্ড: (যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি অন্য একজনের কাছে শুনতে চাইলেন) আচ্ছা ওর উত্তরটা কি হয়েছে?
বোর্ডের অন্য মেম্বার: (একটু ইতস্ততভাবে) হ্যাঁ, হয়েছে।
বোর্ড: আচ্ছা আপনি আসতে পারেন।
বি: দ্র: আমি ভাইভা দিয়েছিলাম বিকেল চারটার পর। বোর্ডের সবাই তখন বেশ ক্লান্ত ছিলেন এবং ভাইভা বোর্ডে আমি সব মিলিয়ে এক মিনিটের মতো ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, তাঁরা আমাকে নেবেন না। বেজায় খারাপ লেগেছিল তাই ভুলে বের হওয়ার সময় তাঁদের সালামও দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
মাহফুজার রহমান, ৩৮তম ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর ব্যাচ,
মার্কেটিং বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মৌখিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা
মনে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়ে ভাইভা বোর্ডের পাশের কক্ষে অপেক্ষা করছি। সিরিয়াল চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে নম্রভাবে কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বোর্ডের কাছে অনুমতি চাইলাম।
আমি: স্যার আসতে পারি?
বোর্ড: জি, আসুন।
আমি: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
বোর্ড: সালাম নিয়ে বসার অনুমতি দিয়ে কাগজপত্রগুলো চাইলেন একজন স্যার। অপর একজন স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পড়ালেখা করেছেন? কোন সাবজেক্ট?
আমি: বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলাম। স্যার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি।
বোর্ড: গুড। বলুন, মার্কেটিংয়ের জনক কে? তিনি কোন দেশের নাগরিক ছিলেন?
আমি: স্যার, মার্কেটিংয়ের জনক ফিলিপ কর্টলার। তিনি আমেরিকার নাগরিক।
বোর্ড: তাঁর বিখ্যাত বইটির নাম বলুন।
আমি: স্যার, তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম Principles of Marketing.
বোর্ড: এই বইয়ে তাঁর একজন সহকারী লেখক আছেন, তাঁর নাম জানেন?
আমি: জি, স্যার। গ্রে আর্মস্ট্রং।
বোর্ড: নীল আর্মস্ট্রং কে ছিলেন?
আমি: স্যার, চাঁদে অবতরণকারী প্রথম ব্যক্তি।
বোর্ড: তিনি কবে চাঁদে পা রাখেন?
আমি: ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে।
বোর্ড: অপর একজন স্যার বললেন, পেছনে তাকান, দেখুন তো কী দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে?
আমি: স্যার, টেলিভিশনের মনিটরে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি দেখা যাচ্ছে।
বোর্ড: বইটি পড়েছেন?
আমি: জি, স্যার।
বোর্ড: বলুন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে কত সাল অবধি ঘটনার কথা আছে?
আমি: স্যার, ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনার কথা লেখা আছে।
বোর্ড: এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর একজন রাজনৈতিক গুরুর কথা বলা আছে। কার কথা বলেছেন, বলতে পারবেন?
আমি: জি স্যার। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
বোর্ড: তিনি কবে মৃত্যুবরণ করেন?
আমি: স্যার, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে।
সবশেষে অপর একজন স্যার বললেন, অনুবাদ করুন, আমার বাবা মাঠে কাজ করেন।
আমি: My father works in the field. (বলে রাখি তাড়াহুড়ো করে বলতে গিয়ে এখানে টেন্স (Tense) ভুল করেছিলাম।
বোর্ড: এবার আসতে পারেন।
আমি: কাগজপত্র নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিয়ে কক্ষ থেকে চলে এলাম।
মৃদুল মিত্র, ৩৬তম সাব-ইন্সপেক্টর,
বাংলাদেশ পুলিশ