তারকা কি হতেই হবে!
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রকাশিত: ০২:০৮ এএম, শনিবার, ২২ আগস্ট ২০২০ আপডেট: ০২:০৮ এএম, শনিবার, ২২ আগস্ট ২০২০
কয়েক দিন আগে প্রকাশিত একটি খবরে দেখেছি, জন্মদিন উপলক্ষে বন্ধুর হাত গাছে বেঁধে, মাথায় ডিম ভেঙে, বন্ধুর মুখে আটা-ময়দা মাখিয়ে দিচ্ছে রংপুরের একদল তরুণ। শুধু তা–ই নয়, ফেসবুকে তারা এই উদযাপন লাইভও করেছে। ব্যতিক্রমী হওয়ার এই ধরনের অদ্ভুত ঘটনা হরহামেশাই নজরে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। টিকটকের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করছে অনেকেই।
কিছুদিন আগে দিয়াবাড়ি যাওয়ার পথে প্রায় পাঁচ-ছয় জায়গায় নজরে পড়েছে কিশোর আর তরুণদের, যারা ব্যস্ত ছিল টিকটকের শুটিংয়ে। যেনতেন উপায়ে বিখ্যাত হওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে অনেক কিশোর–তরুণের কাছে। সবাই তারকা হতে চায়। কিন্তু কোন উদ্দেশ্য পূরণে তারা তারকা হতে চায়, সেই প্রশ্নের উত্তর অস্পষ্ট তাদের কাছে। আর আমাদের কাছে তো বটেই।
অনেকেই ভাবছে, টিকটকে গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কিংবা সিনেমার সংলাপের সঙ্গে ভিডিও জুড়ে দিয়েই যদি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, তবে কী দরকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার? অবাক করা বিষয় হলো অনেকের কাছে এই সব ভিডিওর গুণগত মানও নির্ধারিত হচ্ছে লাইক, ভিউ আর কমেন্টের সংখ্যা দিয়ে। এই ধারায় গা ভাসিয়ে কেউ কেউ যে বিখ্যাত হচ্ছে না, তা–ও কিন্তু নয়। তবে সে সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। প্রশ্ন হলো আজকের প্রজন্ম কেন এত সস্তা খ্যাতির পেছনে ছুটছে!
২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘লুক অ্যাট মি, দ্য ফেইম মোটিফ ফ্রম চাইল্ড হুড টু ডেথ’ গ্রন্থে লেখক অরভিল গিলবার্ট ব্রিম বিভিন্ন জরিপের উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সেই সময় তারকা হতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ মিলিয়ন। তারকা হওয়ার এই অভিলাষ প্রযুক্তির বদৌলতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।
আমেরিকান সাইকোলজিস্ট ডারা গ্রিনউড ও তাঁর সহযোগীরা ২০১৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করেন, মানুষ মূলত তিনটি কারণে বিখ্যাত হতে চায়: ১. অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২. বাস্তব জীবনে অতিরিক্ত কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য এবং ৩. বৃহত্তর কল্যাণে নিজের খ্যাতিকে কাজে লাগানোর জন্য।
গবেষণায় বেরিয়ে আসে তৃতীয় উদ্দেশ্যে খ্যাতি লাভ করতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম। একই গ্রন্থে যুক্তরাজ্যে ১৬ বছর বয়সী ১০৩২ জনের মধ্যে পরিচালিত আরেকটি জরিপের কথা বলা হয়, যাদের প্রায় অর্ধেকই তারকাখ্যাতি লাভ করতে চেয়েছিল। নিজেদের পেশাগত জীবন নিয়ে তেমন কোনো বড় স্বপ্ন দেখার কথা জানায়নি এরা। অনেকেরই তারকাখ্যাতি পাওয়ার পেছনে নিজের মেধা কিংবা প্রতিভা বিকশিত করার তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। এ জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রম করতেও রাজি নয় তারা।
বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অনেকেই আজকাল সুখ্যাতি আর কুখ্যাতির মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করার বিবেচনা বোধটুকু হারিয়ে ফেলছে। সহজ পথে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার নেশায় অনেকের ব্যক্তিত্ব পূর্ণতা পাচ্ছে না, স্বকীয় কোনো পরিচয় তৈরি হচ্ছে না।
অনেকে আবার অল্প পরিশ্রমে তারকাখ্যাতি পেলেও তা ধরে রাখতে পারছে না। আর যারা কোনোভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তারা ডুবে যাচ্ছে হতাশায়। এ যেন এক মরীচিকা। হাজার হাজার ইউটিউব চ্যানেল তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এত ইউটিউবারের ভিড়ে সাবস্ক্রাইবার পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ সবাই শিল্পী হলে দর্শক হবেন কে?
কিন্তু খ্যাতির এই মিথ্যা মোহ থেকে দূরে রাখতে হবে কিশোর আর তরুণ প্রজন্মকে। যেনতেন উপায়ে জনপ্রিয়তা লাভ করতে চায় মূলত তারাই, যারা ব্যক্তিগত জীবনে নিজেদের উপেক্ষিত বলে অনুভব করে। তাই তরুণ প্রজন্মেকে তাদের অস্তিত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে, তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশার বার্তা তুলে ধরতে হবে, তাদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। ওদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে ওদের শূন্যতার জায়গাটুকু। তাদের বোঝাতে হবে লাইক, কমেন্ট আর ভিউয়ের পেছনে ছোটার চেয়ে জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের সত্যিকার প্রতিভাকে চিনতে পারা এবং মূল্যায়ন করতে শেখার সক্ষমতা অর্জন করা, তবেই না প্রতিভা বিকশিত হবে।
যার ওপর ভিত্তি করে জনপ্রিয়তা, তা যদি মজবুত না হয় তবে যেকোনো সময় তা ধসে পড়বে। খ্যাতির কোনো শেষ নেই, চাহিদার কোনো সীমা নেই আবার সন্তুষ্টি পরিমাপেরও সর্বজনস্বীকৃত কোনো মানদণ্ড নেই। তাই আকাঙ্ক্ষার লাগাম টেনে ধরতে হবে।
শুধু খ্যাতির পেছনে ছুটে চলার চেয়ে জরুরি হলো নিজেকে সুখী ভাবতে শেখা, আশপাশের সবাইকে সুখী রাখতে পারা। ব্যক্তিগত জীবনে তারকা হয়ে ওঠার স্বপ্নের বীজ বপন করতে হবে ওদের মনে। মানুষের মনে স্থায়ী আসন লাভের জন্য প্রয়োজন সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ় সংকল্প আর অধ্যবসায়। নিজের স্বকীয়তা আর আত্মমর্যাদা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে যা সত্য, সুন্দর আর শাশ্বত তা উদ্ভাসিত হবেই, অন্যদিকে যা কিছু মেকি তা খসে পড়বেই।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক