ঢাকা, শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩  |  Friday, 9 June 2023  |  এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

খোঁজ দ্যা সার্চ


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ০১:০২ এএম, বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭    
খোঁজ দ্যা সার্চ
খোঁজ দ্যা সার্চ

একসময় বাংলাদেশে অসাধারণ সব বাংলা নামের সিনেমা হতো। মুখ ও মুখোশ, জীবন থেকে নেয়া, স্বরলিপি, অবুঝ মন, সুতরাং, কাঁচের দেয়াল, রূপালী সৈকতে, সীমানা পেরিয়ে, মেঘের অনেক রং- নাম শুনলেই মন ভালো হয়ে যেত। তখন কোনো কোনো বাংলা সিনেমার পোস্টারে ছোট্ট করে একটা ইংরেজি নাম থাকতো, আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। ‘যখন বৃষ্টি এলো’র ইংরেজি হয় ‘দ্যা রেইন’ (স্মৃতি থেকে লিখছি, ঠিক হলো না উল্টো হলো জানি না)। 

কয়েক বছর আগে যখন অশ্লীলতার অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছিল বাংলা সিনেমাকে, তখন নাম হয়ে যায় ‘খাইছি তোরে’ মার্কা। ইদানীং আবার বাংলা সিনেমার ইংরেজি নামের ফ্যাশন চলছে- ঢাকা অ্যাটাক, মিসড কল, বিগ ব্রাদার, ব্ল্যাক মানি ধরনের অদ্ভুতুরে নামে। কেউ ভাববেন না, এই প্রথম বাংলা সিনেমার ইংরেজি নাম। সম্ভবত সত্তরের দশকে `দ্যা ফাদার` নামে অসাধারণ একটা সিনেমা হয়েছিল। তবে একই সঙ্গে বাংলা সিনেমার বাংলা ও ইংরেজি নামের চলটা আবার চালু করেন হালের ক্রেজ অনন্ত জলিল। তার ছবির নাম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, পোস্টারে এর ইংরেজি লেখা থাকে `what is love`. ইংরেজির প্রতি অনন্ত জলিলের আসক্তির কথা আপনাদের সবার জানা। তাই তার সিনেমার নামে একটু ইংরেজি প্রাধান্য পায়- দ্যা স্পিড, মোস্ট ওয়েলকাম। তবে অনন্ত জলিলের প্রথম সিনেমাটি অভিনব, বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে খিচুড়িমার্কা নাম- ‘খোঁজ দ্যা সার্চ’। এখন বাংলাদেশে যেন সেই সিনেমা রিমেক হচ্ছে, শুটিং চলছে সাড়ম্বরে। ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি খুঁজছে ১০ জন নিরপেক্ষ ব্যক্তি। আহারে বেচারা সার্চ কমিটির সদস্যদের জন্য আমার মায়াই লাগছে। নিরপেক্ষ মানুষের খোঁজে তারা চিরুনি অভিযান চালাচ্ছেন- হেথায় খুঁজি, হোথায় খুঁজি, সারা বাংলাদেশে। খুঁজে খুঁজে তারা হয়রান, এই নিজেদের মধ্যে মিটিং করছেন, এই সুশীল সমাজকে ডেকে কথা বলছেন, এই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলছেন; রীতিমত গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু নিরপেক্ষ মানুষ পাবেন কোথায়? এ যে সোনার পাথরবাটি। 

আমড়া গাছে যেমন আম হয় না, অমাবস্যায় যেমন চাঁদের দেখা মেলে না, ডুমুরের যেমন ফুল হয় না; মানুষ তেমন নিরপেক্ষ হয় না। তবে রাষ্ট্রপতি যদি ‘খোঁজ দ্যা সার্চ’ কমিটিতে অনন্ত জলিলকে অন্তর্ভুক্ত করতেন, তাহলে একটা সম্ভাবনা ছিল। বাংলাদেশে একমাত্র অনন্ত জলিলের পক্ষেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মত যোগ্য, দক্ষ, সৎ লোক অনেক আছেন; কিন্তু নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বাটি চালান দিয়েও খুঁজে পাবেন না। আওয়ামী লীগ যদি আসিফ নজরুলের নাম প্রস্তাব করে বিএনপি আপত্তি জানাবে, বিএনপি যদি মোহাম্মদ এ আরাফাতের নাম প্রস্তাব করে আওয়ামী লীগ সন্দেহ করবে।

বেগম খালেদা জিয়ার একটি কথা নিয়ে যুগ যুগ ধরে সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমি তাঁর সাথে একমত ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই।’ আসলেই একটা সুস্থ, সবল, বিবেকবান মানুষ নিরপেক্ষ হবেন কেন? তিনি অবশ্যই তার বিবেচনায় ন্যায়ের পক্ষে, একটা আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেবেন, সত্যের পক্ষে থাকবেন। যদি কেউ নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করেন, তাহলে আমি বলবো তিনি ভণ্ড, সুবিধাবাদী ও বিবেকবর্জিত মানুষ। একজন দৃঢ়চিত্তের বিবেকবান মানুষের কাছে আমি আশা করবো তিনি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করতে পারেন, তবে কোনো দলের কাছে তাঁর বিবেক বন্ধক দেবেন না। তিনি দলনিরপেক্ষ হতে পারেন, কিন্তু আদর্শ নিরপেক্ষ যেন না হন। এ অবস্থায় সার্চ কমিটির পক্ষে ১০ জন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য লোক খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদায় সুই খোঁজা বা হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান বিমান এমএইচ৩৭০ খুঁজে বের করা সমান কথা।

সার্চ কমিটি গঠন নিয়েও রাষ্ট্রপতিকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বিএনপি-আওয়ামী লীগের সাথে তো বৈঠক করেছেন-ই, আরো ২৯টি দলের সাথে বৈঠক করেও তাঁকে সময় নষ্ট করতে হয়েছে। সংলাপের সময় রাষ্ট্রপতিকে সৌজন্যের খাতিরে কোনো দলকে ডাকতে হয়েছে, কোনো দলকে ডাকতে হয়েছে তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস বজায় রাখতে, কাউকে ডাকতে হয়েছে মান ভাঙাতে। 

কয়েকদিন আগে জঙ্গিদের হুমকি পাওয়াকে সুশীল সমাজের এক ধরনের স্ট্যাটাস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। হুমকির তালিকায় নাম না থাকায় অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে মন খারাপ করতে দেখেছি। অনেকে তালিকায় নাম তোলার জন্য হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে গিয়েছিলেন। সোশ্যাল স্ট্যাটাস বহাল রাখতে নাকি কেউ কেউ ভুয়া থ্রেট আনিয়ে তা জাহির করেছেন। তেমনি বঙ্গভবন থেকে ডাক আসাটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একধরনের সোশ্যাল স্ট্যাটাস। অনেক দল নাকি উপযাজক হয়ে চেয়ে দাওয়াত নিয়েছে। নইলে যে চাঁদাবাজির বাজারে রেট কমে যাবে। ডোনাররা যদি বলে বসে, ‘ঐ মিয়া আপনেরে তো বঙ্গভবন থিক্যা ডাকে নাইক্যা, চান্দা দিমু কেলা’।

৩১ দলের নেতাদের সাথে চা খেলেও রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি করেছেন তার নিজের ইচ্ছামত। দুজন বিচারপতি, দুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। চমৎকার কম্বিনেশন। সুশীল সমাজ সার্চ কমিটিকে স্বাগত জানালেও আপত্তি জানায় বিএনপি। বাংলাদেশে অবস্থাটা এমন ভিন্ন গ্রহ থেকে লোক আনলেও বিএনপি আপত্তি জানাতো। তবে তাদের আপত্তির যৌক্তিক-অযৌক্তিক দুটি দিকই আছে। তারা বলছেন, বিচারপতি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা তো আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ করা। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ গত ৮ বছর ক্ষমতায়, তাই সবই এখন তাদের নিয়োগ করা। এর বাইরে তো আর কাউকে পাওয়া যাবে না। 

প্রশ্নটা হলো, রাষ্ট্রপতি যাদের সার্চ কমিটিতে নিয়োগ দিয়েছেন, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন কিনা বা অতীতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অন্ধ দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ আছে কিনা? বিএনপির এই আপত্তি বিবেচনায় নিলে কোনো কাজের জন্য আর কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আওয়ামী ঘরানার হলেও তাঁর দলীয় সম্পৃক্ততা নেই। বিএনপিও তাঁর ব্যাপারে আপত্তি করেনি। বিএনপির মূল ও যৌক্তিক আপত্তি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. শিরিন আখতারকে নিয়ে। তিনি নিজে একসময় মহিলা আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত ছিলেন। তার পিতা কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সন্দেহ নেই তিনি আওয়ামী পরিবারের সদস্য। আর আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে এতটা সম্পৃক্ত কাউকে সার্চ কমিটিতে না রাখলেই ভালো হতো। 

বিএনপি শুরুতে আপত্তি করলেও পরে কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নাম দিয়েছে। এটা খুবই ইতিবাচক। তবে নাম দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি আছে। সার্চ কমিটি ৩১টি দলের কাছে নাম চেয়েছিল। ২৫টি দল দিয়েছে। ২৫টি দল পাঁচজন করে মানুষের নাম দিলে সংখ্যাটা ১২৫। তবে এদের মধ্যে অনেকের নাম নিশ্চয়ই কমন আছে। কয়েকদিন আগে আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম সম্ভাব্য কমিশনারদের নাম চেয়ে। তাতে অনেকে অনেক নাম প্রস্তাব করেছেন। মজার কথা হলো, সেই নামের অনেকগুলো আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনায়ও। রাজনৈতিক দলের নাম থেকে সার্চ কমিটি প্রাথমিকভাবে ২০ জনের নাম বাছাই করেছে। তার সাথে তাদের নিজেদের আরো কিছু নাম যুক্ত করে তা থেকে ১০টি নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনার নিয়োগ করবেন। 

রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির দেয়া প্রস্তাবনা ফলো করতেও পারেন, না করলেও অসুবিধা নেই। নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি ৭০ বছরের কম বয়স, রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকা, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কোনো সুবিধা না নেয়া ইত্যাদি যোগ্যতা বাছাই করছেন। তবে সবকিছু চূড়ান্ত করার আগে সার্চ কমিটি সম্ভাব্য ব্যক্তিদের এমআরআই রিপোর্ট দেখে নিতে পারেন। তাদের মেরুদণ্ড শক্ত আছে কিনা, সেটাই হওয়া উচিত প্রধান বিবেচ্য। আদর্শনিরপেক্ষ খোঁজা উচিত নয়, দলনিরপেক্ষ পাওয়া কঠিন; তবে সাহসী, কারো ধমকে নুয়ে পড়বেন না, এমন প্রজ্ঞাবান মানুষেরাই পারেন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে, তিনি যে আদর্শেরই হোন। আর সম্ভাব্য কমিশনাররা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দেশপ্রেমিক মানুষ হবেন, এটা খুব মিনিমাম চাওয়া।

তবে রাজনৈতিক দলের নাম প্রস্তাবনায় আমার আপত্তি অন্যখানে। এই যে রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনায় অনেকের নাম এলো, তার মানে তাদের কপালে সারাজীবনের জন্য একটি দলের সাইনবোর্ড লেগে গেল। এটা এমন প্রকাশ্যে করা উচিত হয়নি। এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রাখা উচিত ছিল।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আমরা নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন করতে পারিনি। অথচ এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। আগেরগুলো বাদ, ৯০এর পরের ২৬ বছরের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আমরা এটা করতে পারিনি। এ ব্যর্থতা, এ অনীহা আমাদের রাজনীতিবিদদের। আইন হয়ে গেলে পাঁচ বছর পরপর কমিশন গঠন নিয়ে জটিলতা হতো না, সার্চ কমিটির নামে এরকম নাটক করতে হতো না। প্রত্যেকবার কমিশন গঠনের আগে আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে। সময়ের স্বল্পতার কথা বলে আমরা এ দফা এড়িয়ে যাই। তারপর ভুলে যাই। আবার আমাদের ঘুম ভাঙে পাঁচ বছর পর। দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের। তাহলে অনেক ঝামেলা এক লহমায় মিটে যাবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন...