ঢাকা, সোমবার ১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৭ | এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

করোনা সংক্রমণের উৎস রোধে নজর নেই দেশের


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ০৬:০৭ পিএম, মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই ২০২০   আপডেট:   ০৬:০৭ পিএম, মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই ২০২০  
করোনা সংক্রমণের উৎস রোধে নজর নেই দেশের
করোনা সংক্রমণের উৎস রোধে নজর নেই দেশের

করোনা সংক্রমণের উৎস বন্ধে নজর নেই বাংলাদেশের। কর্মকর্তা ও চিকিৎসা পেশাজীবীরা রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের চেয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এমন অভিমত দিয়েছে চীনের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ দল। 

বাংলাদেশ সফরে এসে এসব দুর্বলতা শনাক্তের পাশাপাশি চীনের বিশেষজ্ঞ দল করোনা সংক্রমণ রোধে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। তাদের ছয় দফার সুপারিশের মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দান, পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো, হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা। 

ঢাকা ও বেইজিংয়ে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা গত রোববার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সফর শেষে জুনের শেষ সপ্তাহে প্রতিনিধিদলটি ফিরে যায়। জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে তারা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় চীনের উপরাষ্ট্রদূত ইয়ান হুয়ালং গতকাল মঙ্গলবার বলেন, চীনের বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদন এরই মধ্যে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে চীনের উপরাষ্ট্রদূত কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সহায়তা চাইলে চীন সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। 

ডা. লি ওয়েনশিউর নেতৃত্বাধীন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১০ সদস্যের চীনা প্রতিনিধিদলটি ৮ জুন দুই সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসে। এরপর তাঁরা ঢাকায় থেকে ভার্চ্যুয়ালি চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা

চীনের প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মাঝারি ও গুরুতর উপসর্গের রোগীদের যথাযথভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মৃদু উপসর্গ রয়েছে এমন রোগীদের বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মানসম্পন্ন ও কার্যকর নজরদারির অভাবে সংক্রমণের উৎস এবং এর বিস্তার শুরুতেই দমন করা যাচ্ছে না। এতে তাঁদের মাধ্যমে গুরুতরভাবে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। 

এই পরিস্থিতিতে চীনের বিশেষজ্ঞ দল বিভিন্ন পর্যায়ের রোগীদের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় চিকিৎসার জন্য কিছু সুপারিশের কথা বলেছে। 

প্রথমত, রোগীর উপসর্গগুলোর দিকে নিবিড়ভাবে লক্ষ রাখা এবং যত দ্রুত সম্ভব অক্সিজেন থেরাপির ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়ত, শুরুতেই রোগ চিহ্নিত করা গেলে রোগী যাতে মাঝারি পর্যায় থেকে গুরুতর পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে না পড়েন, সেটি নিশ্চিত করা যায়। 

তৃতীয়ত, রোগীদের যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মাঝারি উপসর্গের রোগীদের অস্থায়ী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে। আর গুরুতর রোগীদের পাঠাতে হবে বিশেষায়িত হাসপাতালে। 

চতুর্থত, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুই রোগীর জন্য একটি ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে সহায়তার জন্য অনুরোধ জানাতে হবে। 

পঞ্চমত, জটিল রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নজর দিতে হবে। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের চিকিৎসকদের নিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল গঠন করতে হবে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে মৃত্যুহার কমানো।

চীনা প্রতিনিধিদল মনে করে, বড় ধরনের সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অস্থায়ী হাসপাতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অস্থায়ী হাসপাতালে রোগী রেখে সংক্রমণের উৎস থেকে নির্মূল করা যায়। এর ফলে মাঝারি মাত্রার সংক্রমণ ভয়াবহ মাত্রায় রূপ নেওয়ার হার কমানো যায়, কমানো যায় মৃত্যুর হারও। 

ল্যাবের সামর্থ্য বাড়ানো

চীনের প্রতিনিধিদলের মূল্যায়ন হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা শনাক্তের জন্য আরটি-পিসিআর পরীক্ষা অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ৬০টি পরীক্ষাগারে মাত্র ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে (চীনা প্রতিনিধিদলের সফরের সময়), যা পর্যাপ্ত নয়। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয়, তাতে রোগীর দেহ থেকে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। মানসম্পন্ন বায়োসেফটি প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে ল্যাবে কর্মরত লোকজনের দেহে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। ল্যাবগুলোতে সহায়তাকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি সচেতনতার অভাবেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। 

বাংলাদেশের ল্যাবগুলোর এসব দুর্বলতা দূর করতে চীনের উহানের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। 

প্রথমত, ল্যাবের সংখ্যা বা পরিধি বাড়াতে হবে। সারা দেশেই একই মানের ল্যাব তৈরি করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ানো হয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি পেশাদার ল্যাবগুলোকে পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, ল্যাবের বায়োসেফটি জোরদারের পাশাপাশি কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, ভুল নেগেটিভ ও পজিটিভ রিপোর্টের হার কমিয়ে ল্যাবগুলোর পরীক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, ল্যাব চালাতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে। ল্যাবে পালা (শিফট) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা এবং যন্ত্রপাতি চালু থাকে। এর ফলে একেবারে কম সময়ের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। 

পঞ্চমত, সংক্রমণ কমাতে নমুনা সংগ্রহের জন্য বিশেষায়িত স্থান ঠিক করতে হবে। 

হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশ সফরের সময় চীনের প্রতিনিধিদলটি দেখেছে, মেডিকেল কলেজগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার জন্য বিশেষায়িত কোনো বিভাগ নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সার্বক্ষণিকভাবে কোনো ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও সহায়তাকর্মীদের সংক্রমণ কমাতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। 

প্রথমত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ বাড়ানো।

দ্বিতীয়ত, মানসম্পন্ন মেডিকেল কলেজগুলো বিশেষায়িত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ চালু করতে পারে। 

তৃতীয়ত, দায়িত্বশীল লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে কাজের সময়সীমা ঠিক করে দিতে হবে। সম্মুখসারির যোদ্ধাদের আলাদা করে এক জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে তাঁদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা সহায়তাকর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও সংক্রমণের বিষয়টিতে তদারকি বাড়াতে হবে।

চতুর্থ, রোগনির্ণয়, চিকিৎসা ও সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। 

পঞ্চমত, একেবারে বিচ্ছিন্ন পরিষ্কার এলাকা, সম্ভাব্য সংক্রমিত এলাকা এবং সংক্রমিত এলাকা—এই তিন এলাকায় আইসোলেশন ওয়ার্ড গড়ে তুলতে হবে। আর রোগী এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা সহায়তাকর্মীদের চলাচলের পথ হবে আলাদা। 

এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী করছে তা জানার জন্য গতকাল সন্ধ্যায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সংশ্লিষ্ট পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকে বলেছেন, এই প্রতিবেদন সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, চীনা প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন সম্পর্কে কমিটি অবহিত নয়। সরকার মনে করলে কিছু সুপারিশ সরাসরি বাস্তবায়ন করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে।

আপনার মন্তব্য লিখুন...