একাত্তরের জননী খ্যাত বীরমাতা চেতনার বাতিঘর সাহিত্যিক মুক্তিযোদ্ধা রমা চোধুরী আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৯ পিএম, শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮
রমা চৌধুরী (১৯৪১ - ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত একজন বীরাঙ্গনা।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) নারী। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ।ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। এসব ঘটনার বিবরন পাওয়া যায় তার লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার সন্তান সাগরের। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় সাগর। একাত্তরের জননী গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তির পরে দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বর্তমান ছিলো । প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী।তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী।
