Oops! It appears that you have disabled your Javascript. In order for you to see this page as it is meant to appear, we ask that you please re-enable your Javascript!
ঢাকা, বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩  |  Wednesday, 22 March 2023  |  এখন সময়:

Advertise@01680 34 27 34

চা বিক্রেতা, ভাতের বিনিময়ে টিউশনি এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা


অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত:   ১১:০৩ পিএম, শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০২২   আপডেট:   ১১:০৩ পিএম, শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০২২  
চা বিক্রেতা, ভাতের বিনিময়ে টিউশনি এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা
চা বিক্রেতা, ভাতের বিনিময়ে টিউশনি এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানার আস্তানার পাশে পদ্মা নদীর ঠিক তীর ঘেঁষে একটা চায়ের দোকান। সেখানে প্রায় ৬০ রকম চা-কফি পাওয়া যায়। গ্রামের মাঝে এত রকমের চা-কফি পাওয়া যাবে; অন্তত আমার ধারণায় ছিল না। মাঝবয়সী এক লোক চা বানাচ্ছেন খুবই দক্ষতার সঙ্গে। পাশে ১০ থেকে ১২ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে তাঁকে সাহায্য করছে চায়ের কাপগুলো ধুয়ে দিতে। লোকটা এত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছিলেন, মনে হলো তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এত রকমের চা বানানো কোথায় শিখেছেন?’ প্রশ্ন করতেই তিনি ইতিহাস বলতে শুরু করলেন। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, গ্রামের কেউ হয়তো কখনো তাঁর গল্প শুনতে চায়নি। হঠাৎ আমার প্রশ্ন শুনে তাঁর হয়তো খুব ইচ্ছা করছিল নিজের ইতিহাস বলতে।

কম বয়সে মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে কুষ্টিয়া থেকে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সিলেটে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। তখনো বয়স অনেক কম। সেখানেই শিখেছেন ৬০ রকম চা-কফি বানানো। একটা সময় কুষ্টিয়ায় নিজের এলাকায় ফিরে এসে পদ্মা নদীর ঠিক পাশে নিজেই একটা চায়ের দোকান দিয়ে বসেন। তাঁর ব্যবসা যে বেশ ভালো চলছে, সেটা খুব বোঝা যাচ্ছিল। চারপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে। 

তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন আর দ্রুত রংবেরঙের চা বানাচ্ছেন। পাশে ছেলেটা ওনারই সন্তান। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও স্কুলে যায় না?’ তিনি যে উত্তর দিয়েছেন, এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না: ‘ছেলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। লিখতে-পড়তে পারে। আমি চাই না সে আর লেখাপড়া করুক। আমি চাই সে দোকানে থেকে কাজ শিখুক। এরপর এই ব্যবসাটা সে দেখভাল করুক।’

খুব অবাক হয়েছিলাম তাঁর উত্তর শুনে। যেখানে সব মা-বাবা চান সন্তান লেখাপড়া শিখে বড় হোক। সেখানে এই লোক কিনা বলেছেন তাঁর সন্তানের লেখাপড়া শেখার দরকার নেই! জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, ‘ও আমার একমাত্র ছেলে। আরেকটু বেশি লেখাপড়া শিখে গেলে এরপর আর এ কাজ করতে চাইবে না। তখন এসব কাজকে ও ঘৃণা করবে। লেখাপড়া শিখে যে ও চাকরি পাবে, এর নিশ্চয়তা আছে? কিন্তু এটা নিশ্চিত, ওর বাপ যে কাজ করছে, সেই কাজ ও করতে চাইবে না। এ জন্য আমি চাই না ও আর লেখাপড়া শিখুক।’

এর বেশ কিছুদিন পর আমি বিদেশে ফেরত এসেছি। একদিন দেখি পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, বগুড়ায় এক ছেলে দুই বেলা খাওয়ার বিনিময়ে টিউশনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ছেলেটা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটা কলেজ থেকে। এই ছেলেকে কেন দুই বেলা খাওয়ার চিন্তা করতে হচ্ছে? কেন তিনি নিজের মতো করে ছোটখাটো কিছু একটা করতে পারছেন না? এরপরই কুষ্টিয়ার ওই চা বিক্রেতার কথা মনে হলো। মাস্টার্স পাস করে তিনি হয়তো ভাবছেন, ছোটখাটো কাজ করা তাঁর উচিত হবে না। কিংবা তাঁর হয়তো সে অর্থে পড়াশোনার বাইরে আর কোনো দক্ষতা নেই। যে দক্ষতা দিয়ে তিন একটা চাকরি পেয়ে যাবেন কিংবা নিজে কিছু করে চলতে পারবেন।

এই থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে শিক্ষাপদ্ধতি রয়েছে, সেটা আসলে বর্তমান পৃথিবীর শ্রমবাজারের সঙ্গে খুব একটা যায় না। যার কারণে প্রতিবছর হাজারো গ্র্যাজুয়েট বের হন। সেই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত বেকারের সংখ্যাও বাড়ে। এর মধ্যেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক দিন আগেই শুনতে পেলাম দুটি জেলায় নতুন করে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে।

এত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি আমাদের আদৌ দরকার আছে? এত এত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে আমাদের লাভ কী, যদি দক্ষতা না বাড়ে? কেন আমরা দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে স্রেফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছি? কেন এক বাবাকে চিন্তা করতে হচ্ছে তার সন্তান পড়াশোনা শিখে যে চাকরি পাবে, এর তো নিশ্চয়তা নেই। উল্টো বাবা যে কাজ করেন, সেই কাজকে ঘৃণা করবে একসময়!

গবেষণাপদ্ধতির এই শিক্ষা যদি সঠিকভাবে শেখানো যায়, তাহলে এই ছাত্ররা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করতে পারবেন। বিদেশের অনেক সংস্থায় কর্মের সংস্থান হবে। শুধু গবেষণাপদ্ধতি নয়, কীভাবে একাডেমিক পেপার লিখতে হয় (একাডেমিক রাইটিং), কীভাবে লিটারেচার রিভিউ করতে হয়, কীভাবে রেফারেন্স লিখতে হয়, কীভাবে রিপোর্ট লিখতে হয়—এসবও তো শেখানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই ছাত্ররা শুধু চাকরি নয়, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রিপোর্ট রাইটিং করে দেশে বসে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, লেখাপড়া শিখে তাঁরা সমাজের বোঝা হবেন না। নিজেরাই নিজেদের পথ করে নিতে পারবেন।
পুরো এই বিষয়ের জন্য আলাদা কোনো ল্যাবের দরকার নেই। খুব একটা বেশি অর্থের বা ফান্ডেরও দরকার নেই। স্রেফ ইচ্ছাটুকুই যথেষ্ট। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যদি মনে করে তারা তাদের শিক্ষকদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে এবং তাদের কারিকুলামে এই বিষয়গুলো যুক্ত করে দেবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করবে, তাহলে এটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। এর মধ্যেই তারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু পুরো বিষয় একটা পরিকল্পনা করে এরপর সামনে এগোনো দরকার, যাতে প্রজেক্ট থেকে শুধু শিক্ষকেরাই লাভবান না হন; দিন শেষে যেন ছাত্ররাও লাভবান হন। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য একটা উদ্যোগ নিয়েছেন, যেটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এই উদ্যোগের ফলে যেন সাধারণ ছাত্ররা ভালো কিছু শিখতে পারেন তাঁদের শিক্ষকদের কাছ থেকে, সে পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় ক্লাস হয় না, পড়াশোনার মান ভালো না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়।

শুধু শুধু একাডেমিক ডিগ্রি কিংবা তাত্ত্বিক শিক্ষা না নিয়ে বরং বাস্তবে কাজে লাগে—এমন শিক্ষা দিতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে একটা বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীন শত শত কলেজ রয়েছে দেশের আনাচকানাচে। সেখানে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও যাঁরা আধুনিক, বাস্তবসম্মত শিক্ষা নিয়ে দেশ-বিদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারবেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে বরং বর্তমানে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে, সেগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। নইলে দিন দিন হতাশাগ্রস্ত তরুণের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। একটা সময় হয়তো চা বিক্রেতা ওই বাবার মতো লোকজন ভাববে, দরকার নেই সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় দিয়ে।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে এখন। অনেকেই বলাবলি করছে, পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থী নিতে নাক-উঁচু ভাব দেখালেও ইউক্রেন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরণার্থী নিচ্ছে। অনেকে এর সঙ্গে বর্ণবাদেরও তুলনা করছে। বর্ণবাদ একটা কারণ হতে পারে। তবে অন্য একটা কারণের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
ইউক্রেনের প্রায় শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। সেই সঙ্গে ওদের শিক্ষার মানও অনেক ভালো। পশ্চিমা দেশগুলো ভালো করেই জানে, এই শরণার্থীরা আর যা-ই হোক, সমাজের বোঝা হবে না। এরা নিজেরাই নিজেদের জন্য কোনো না কোনো কাজ জুটিয়ে নেবে। বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সেটা কেবল সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য শিক্ষা নয়; বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবসম্মত কর্মমুখী শিক্ষা।

ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ
এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
ই-মেইল: aminulislam1255@yahoo.com

মতামত থেকে আরও পড়ুন

শিক্ষার মান জনশক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বেকারত্ব শিক্ষা উচ্চ শিক্ষা

আপনার মন্তব্য লিখুন...